আপন মনে চলছে শীর্ষ মেগা প্রকল্পগুলো
-রূপপুরের ৭ বছরে অগ্রগতি মাত্র ৬০.৪৬ শতাংশ
-দোহাজারী থেকে ঘুমধুম রেলপথ ১৩ বছরে ৮৬ শতাংশ
-মহেশখালীর-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো ৯ বছরে ৭৬.৮ শতাংশ
আপন মনে চলছে শীর্ষ মেগা প্রকল্পগুলো – ছবি : সংগৃহীত
সমাপ্ত হতেই চাচ্ছে না ফাস্ট ট্র্যাক বা শীর্ষ মেগা প্রকল্পগুলো। আপন মনে বাস্তবায়ন কাজ চলছে। মেয়াদ না বাড়লে আগামী এক বছরে অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুনে সমাপ্ত করতে হবে পদ্মা সেতুতে রেললাইন নির্মাণ, দোহাজারী থেকে ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ, মেট্রোরেল লাইন-৬ এর প্রকল্প। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ গত জুনে মেয়াদ শেষ হলেও কাজ বাকি ১০ শতাংশ। বছরের পর বছর চলছে প্রকল্পগুলোর কাজ। প্রতিটি প্রকল্পই মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়েছে। অন্য প্রকল্পগুলোর রোগও এই প্রকল্পগুলোকে আক্রান্ত করেছে। পরিকল্পনা কমিশনের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তারা বলছেন, সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই, প্রাক্কলন, নকশা ও সঠিকভাবে পরিকল্পনা না করেই প্রকল্পগুলো শুরু করার কারণেই মাঝপথে এসে এগুলোকে দফায় দফায় সংশোধন করা হচ্ছে। পাশাপাশি দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে প্রকল্পের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না। এমনকি মন্ত্রণালয়গুলোর মনিটরিং তেমন ভাবে করা হচ্ছে না। ফলে প্রকল্পগুলো আপন মনে চলছে।
ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের সর্বশেষ জুন পর্যন্ত বাস্তবায়নের সরকারি হিসাবের তথ্য থেকে জানা গেছে, পদ্মা সেতু বাদে ফাস্ট ট্রাকের ছয় প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে খরচ হয়েছে এক লাখ ৬২ হাজার ৯৮৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এই প্রকল্পগুলোর জন্য অনুমোদিত খরচ দুই লাখ ৬০ হাজার ৭৫ কোটি ৫৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা। বড় খরচের প্রকল্পগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যয়ের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি সাত বছরে মাত্র ৬০.৪৬ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। আর ৮৬ শতাংশ ভৌত কাজ করতেই দোহাজারী থেকে রামু, কক্সবাজার হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ প্রকল্পের ১৩ বছর শেষ। সাত বছর সময়ে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগের অগ্রগতি ৮০ শতাংশ এবং ৮ বছরে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৯.৮৭ শতাংশ।
আইএমইডির প্রাপ্ত তথ্য বলছে, সবচেয়ে ব্যয়বহুল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়া থেকে ঋণ নেয়া হয়। গত ২০১৬ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটি শুরু হয়ে চলতি বছরের জুন ’২৩ পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৬০.৬৪ শতাংশ। আর ব্যয় হয়েছে ৫৮.২১ শতাংশ বা ৬৫ হাজার ৮৩০ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এই প্রকল্পের জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। এখানে রাশিয়ার ঋণ হলো ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। আগামী ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত করার কথা। ফলে আড়াই বছরে তাদেরকে ৪০ শতাংশ কাজ সমাপ্ত করতে হবে।
এই তালিকায় রয়েছে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে মিয়ানমারের সীমান্ত ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন রেলের ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পটির ১৩ বছরে অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ। প্রকল্পটি ২০১০ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়। আর ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ১৩ বছরে খরচ হয়েছে ৪৩.৫৪ শতাংশ অর্থাৎ ৭ হাজার ৮৫২ কোটি ২১ লাখ টাকা। প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিদেশী ঋণ ১৩ হাজার ১১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। ২০১০ সালের জুনে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে এখন আগামী ২০২৪ সালের জুনে সমাপ্ত করার কথা। ফলে এক বছরে ১৪ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
আলোচিত পদ্মা বহুমুখী সেতুতে প্রত্যাশিত রেললাইন স্থাপনের জন্য নেয়া প্রকল্পটির সাত বছরে ৮০ শতাংশ কাজ হয়েছে। ওই অগ্রগতিতে খরচ হয়েছে ৭৫.৩৩ শতাংশ বা ২৯ হাজার ৫৬৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা। ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকার বৈদেশিক ঋণসহ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনুমোদিত খরচ ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পটি সমাপ্ত করে রেল চলাচল শুরু করার কথা। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে এই প্রকল্পটির মেয়াদ শুরু হয়। ফলে আগামী এক বছরে প্রকল্পের ২০ শতাংশ কাজ শেষ করতে হবে।
আর মহেশখালীর-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়নকার্যক্রম। এখানে ১২ শ’ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রকল্পসহ মোট ১২টি প্রকল্প রয়েছে। এই বিদ্যুৎ প্রকল্পে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। জুন ’২৩ পর্যন্ত ৯ বছরে প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৭৬.৮০ শতাংশ। আর অর্থ ব্যয় হয়েছে ৬৪.১২ শতাংশ। অর্থাৎ ৩৩ হাজার ২৪৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ রয়েছে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়ে এখন আগামী ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত উন্নীত করা হয়েছে। ফলে আগামী সাড়ে তিন বছরে প্রকল্পের ২৩ শতাংশ কাজ শেষ করতে হবে।
রাজধানীর যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ও যানজট কমাতে নেয়া ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের বা মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ। তবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত লাইনের সুবিধা ভোগ করছে নগরবাসী। জুন ’২৩ পর্যন্ত গত ১১ বছরের কাজে অর্থ ব্যয় হয়েছে ২২ হাজার ৭৩৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৬৭.৯৩ শতাংশ। এই প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। পরে বাড়িয়ে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা করা হয়েছে। বিদেশী ঋণ হলো ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। প্রকল্পটি ২০১২ সালের জুলাইয়ে অনুমোদন নিয়ে শুরু করে। প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান। বর্তমানে দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত রেললাইন চলমান আছে। প্রতিদিনই যাত্রীরা এই অংশের সুফল পাচ্ছে। আগামী ২০২৪ সালের জুনে সমাপ্ত করার কথা। প্রকল্পের কাজ এক বছরে শেষ করতে হবে ২২ শতাংশ।
দেশের অন্যতম তৃতীয় গভীর সমুদ্রবন্দর পায়রা বন্দরের ভৌত কাজ জুন ’২৩ পর্যন্ত হয়েছে ৮৯.৮৭ শতাংশ। এই পর্যন্ত অগ্রগতিতে সময় লেগেছে ৮ বছর। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে আরম্ভ হওয়া এই প্রকল্পটি গত ২০২২ সালের জুনে সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সময় বাড়িয়ে এটাকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। বর্ধিত সময়েও ১০ শতাংশ কাজ বাকি। ৮ বছরে প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭৫২ কোটি ১৩ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৮৫.৭৭ শতাংশ। প্রকল্প খরচের পুরো চার হাজার ৩৭৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা সরকারি অর্থায়ন।