Bangladesh

কঠোর অ্যাকশনে সরকার

ধর্ষণের শিকার শিশু আছিয়াকে বাঁচানো গেল না, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি করা ছাত্রলীগ নেতা জসিমউদ্দিন মানিককে কানাডা পাঠিয়েছিল শেখ হাসিনা, সোহাগী জাহান তনু ও মোসারাত জাহান মুনিয়া ধর্ষণ হত্যাকা-সহ হাসিনার আমলে কয়েক বছরে ধর্ষণের শিকার ৪৩ হাজার নারী-শিশু

মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হওয়া শিশু আছিয়াকে বাঁচানো গেল না। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে ইন্তেকাল করেছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। নিষ্পাপ শিশু আছিয়ার মৃত্যুতে শোকাহত গোটা জাতি। প্রধান উপদেষ্টা, সেনাবাহিনী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে শত শত সংগঠন শিশুটির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় শোক প্রকাশের পাশাপাশি বইয়ে প্রতিবাদের ঝড়। তবে অন্তর্বর্তী সরকার সামাজিক স্খলনজনিত ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। মেয়েটির অকাল মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশের পরই সরকারের কঠোর অ্যাকশনের কথা জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেছেন, ‘মাগুরার শিশুটিকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার বিচার আগামী সাত দিনের মধ্যে শুরু হবে’।

শিশু আছিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যাকা-ের দায়ে অভিযুক্ত আসামিদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। পারিবারিকভাবে ওই আসামিরা ফ্যাসিস্ট হাসিনার দল আওযামী লীগ পরিবারের সদস্য। মূলত স্কুল- কলেজ-বিশ্বিবিদ্যালয়ে নৈতিকতা শিক্ষার অভাবে গত কয়েক বছর ধরে সামাজিক স্খলন বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে হাসিনা রেজিমে প্রগতিশীলতার নামে বিজাতীয় (হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়) সংস্কৃতি চর্চার কারণে দেশে ধর্ষণ জাতীয় অপরাধ বেড়ে গেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য হচ্ছে, ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে কয়েক বছরে ধর্ষণের শিকার ৪৩ হাজার নারী-শিশু। এসব ধর্ষণের দু-একটির বিচার হলেও ৯৯ ভাগ ধর্ষণ ঘটনার বিচার হয়নি। দীর্ঘ ১৫ বছর ছাত্রাবাস থেকে শুরু করে রাজপথে কোথাও বাকি ছিল না ধর্ষণের মচ্ছব। শেষ ছয় বছরেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭ হাজার শিশুসহ প্রায় ৪৩ হাজারের বেশি নারী। এই সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১ লাখ ৩৭ হাজার নারী। অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮ হাজার ৪৮ নারী ও শিশু। অর্ধেকেরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের হাতে। ৪ বছর বয়সী শিশু থেকে শুরু করে ৬০ বছর বয়সী বৃদ্ধা ধর্ষিত হলেও কোনো ধর্ষণের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করা হয়নি। ফলে ধর্ষণের মতো অপরাধ ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু সিদ্ধান্তের ঢিলেমি দেখা গেলেও ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর অ্যাকশনের বার্তা দিয়েছে। আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যাকা-ের বিচার দ্রুতগতিতে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ধর্ষণের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ গ্রহণ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। সরকারও ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ গ্রহণের বার্তা দিয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশু আছিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, মাগুরায় ধর্ষণের শিকার মৃত্যুবরণকারী আছিয়ার মামলার তদন্ত দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে। মাগুরার শিশু ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। পরের দিনই ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের বিচার দ্রুতই শুরু হবে।

পরিবার জানায়, গত ৫ মার্চ বৃহস্পতিবার মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার বাসিন্দা শিশু আছিয়া মাগুরা শহরে বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়। এরপর এদিন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় তাকে মাগুরার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে যান তার বোনের শাশুড়ি। পরে শিশুটির মা হাসপাতালে যান। সেদিন দুপুরেই উন্নত চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ওই দিন রাতে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এরপর গত শুক্রবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (পিআইসিইউ) থেকে সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে পিআইসিইউতে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। চার দফায় স্টোক করার পর সেখানে শিশু আছিয়া মারা যায়। এ ঘটনায় শিশুটির মা বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মাগুরা সদর থানায় মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেনÑ শিশুটির ভগ্নিপতি সজীব হোসেন (১৮) ও বোনের শ্বশুর হিটু মিয়া (৪২), সজীব শেখের অপ্রাপ্তবয়স্ক ভাই (১৭) এবং তাদের মা জাবেদা বেগম (৪০)। তাদের চারজনকেই গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত আসামিরা সবাই নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগ অনুসারী হিসেবে পরিচিত। পুলিশ চার আসামিকেই গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে।
গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের মর্গে (সিএমএইচ) মৃত মেয়েকে রেখে বাইরে আহাজারি করছেন মাগুরার ধর্ষণের শিকার শিশু আছিয়ার মা। এ সময় তিনি বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। জ্ঞান ফিরে তিনি একটি কথা বারবার বলছেন, ‘আমার মেয়ের সঙ্গে যারা খারাপ কাজ করেছে, তাঁদের সবার ফাঁসি চাই।’ কেউ সান্ত¡না দিতে কাছে গেলে শিশুটির মা বলেন, ‘কখনো কখনো মনে হয়েছে মেয়েটা সুস্থ হবে। এবার বেঁচে গেলে আর কখনো বাড়ি থেকে একা ছাড়তাম না। কিন্তু আল্লাহ ডাক শোনেননি।’ স্বজনদের জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলেন, শেষবারের মতো মা বলে আর ডাকল না। মেয়েকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন শিশুটির প্রতিবন্ধী বাবাও। তিনি বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। এর মধ্যেই তিনি ‘ধর্ষকের গোটা পরিবারসহ’ সবার ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা জসিমউদ্দিন মানিকের কথা মনে আছে? ১৯৯৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি করে বন্ধুদের সঙ্গে ১০০তম ধর্ষণ উদযাপন করেন। এ নিয়ে প্রতিবাদের মুখে শেখ হাসিনা গণভবনে তাকে ডেকে পাঠান। অতঃপর তাকে কানাডা পাঠিয়ে দেন। ওই ঘটনার পর কয়েক বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্বাভাবিক হারে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যায়। কেউ কেউ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ধর্ষকের গ্রাম’ হিসেবে অভিহিত করে। কয়েক বছর পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তিতে ছাত্রীদের জন্য বিশেষ কোটা করায় ছাত্রীদের ভর্তি স্বাভাবিক হয়ে আসে।

নিকট অতীতে মূলত ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরে পুলিশ সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত ইয়াসমিন আক্তার নামক ১৪ বছর বয়স্ক এক বালিকার গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ওই ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় অপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসির দ-াদেশ দেয়া হয়। এরপর হাসিনার শাসনামলে কোনো ধর্ষণ ও হত্যাকা-ের ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার হয়নি।

২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনুর ধর্ষণ ও হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। কুমিল্লা শহরের কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাত আসামির বিরুদ্ধে তনুর বাবা ইয়ার হোসেন হত্যা মামলা দায়ের করেন। তনু হত্যার বিচারের দাবিতে হরতাল-অবরোধ-মানববন্ধনের অনেক কর্মসূচি পালিত হয়। দেশে-বিদেশে ওই ধর্ষণকা- নিয়ে তোলপাড় হয়। বছরের পর বছর আন্দোলন হলেও এখনো বিচার হয়নি। ২০১৮ সালে ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে আওয়ামী লীগ নেতার নেতৃত্বে নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবলী ইউনিয়নের মধ্য বাগ্যার গ্রামে স্বামী-সন্তানকে বেঁধে রেখে এক গৃহবধূকে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের শিকার গৃহবধূ পারুল বেগম জানান, ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা সবাই একই এলাকার চরজুবলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের শিষ্য। ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান ওরফে মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সেদিন রাতেই তার বোন নুসরাত জাহান বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করেন। মামলায় বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরকে আসামি করা হয়। মুনিয়া-আনভীরের কয়েকটি কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলেও পুলিশ মোটা অংকের টাকা নিয়ে মামলার চার্জশিটে আনভিরের নাম বাদ দেয়।

হাসিনার শাসনামল ছিল কার্যত জংলি শাসন। অপরাধীদের সমন্বয়ে সিন্ডিকেট করে প্রশাসন চালিয়েছেন হাসিনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী হাসিনার শাসনামলের ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (বিগত ৬ বছর) ৪৩ হাজার ৪৭২টি ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ সময় নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৭ হাজার ৫৭১টি। যৌতুক না পেয়ে ও ধর্ষণের পর হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন ১৫৯ জন নারী। শুধু ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের অভিযোগ আসে ৪ হাজার ৩৩১টি, নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১২ হাজার ৭৬৯টি। এ সময়ে যৌতুক না পেয়ে ও ধর্ষণের পর হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন ১৫৯ জন নারী। থানায় ‘পুলিশশূন্য সময়’ আগস্টে সবচেয়ে কম মামলা হয়েছে।

জুলাই গণবিপ্লবের সময়ে আন্দোলনরত নারী শিক্ষার্থীদের ওপর সংঘটিত নির্যাতন নিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, সরকারি বাহিনী এবং ছাত্রলীগের কর্মীরা নারীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণে বাধা দিতে যৌন নিপীড়ন ও শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছে। কয়েকটি ঘটনায় নারী আন্দোলনকারীদের বেআইনিভাবে আটক করা হয়েছে এবং তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে জাতিসংঘ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানায়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে ১ হাজার ৭ জন নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৭৮৪ জন নারী, ২০২১ সালে ৩ হাজার ৭০৩ নারী ও কন্যাশিশু, ২০২২ সালে ৯৮৭ গণধর্ষণের শিকার হয়েছে পরে হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে ৩৮ জন। ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৯৩৭টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৩৯ জন। কোনো ধর্ষণ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। বরং মুনিয়া হত্যার আসামি দেশের এখন সবচেয়ে বড় সমাজসেবী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

এদিকে শিশুটির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশ শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়ে। একটি অবুঝ শিশু গণনিপীড়নে মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয় বিবেকমান মানুষের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের সারাদিনই শিশু আছিয়ার মৃত্যুকে ঘিরে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মন্তব্য জানিয়েছে পোষ্ট করেছেন। শোকের পাশাপাশি অনেকে ক্ষোভ ওপ্রকাশ করেছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মাগুরায় নির্যাতিত শিশুটির মৃত্যুর ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি শিশুটির ওপর নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন।

আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করে বলেছেন, মাগুরার শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচার আগামী সাত দিনের মধ্যে শুরু হবে। তিনি বলেন ‘সব বিচার রাষ্ট্র করতে পারে না, কিন্তু কিছু কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হয়। এখানে যে বর্বরতা যে নির্মমতা যে পাশবিকতা হয়েছে, এটা শুধু এই বিচার না এটা হচ্ছে যারা ভিকটিম হবে, যারা অতীতে ভিকটিম হয়েছে, তাদের সবার জন্য এটা একটা মেসেজ হবে। রাষ্ট্র এগুলো কোনোভাবেই ক্ষমা করবে না। এটা শুধু এই মেয়েটির বিরুদ্ধে অপরাধ না, এটা হচ্ছে আমাদের সমস্ত কালেকটিভ যে মনোজগত আছে, যে কালেকটিভ কালচার আছে, আমাদের যে একটা আত্মমর্যাদা বোধ আছে, এটার প্রতি অপরাধ। এটার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে।

শিশুটির মামলার তদন্ত দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শিশুটির শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছে এবং যে কোনো প্রয়োজনে তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শিশুটির বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছে।

পুরো বাংলাদেশ বোন আছিয়ার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, লজ্জিত বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে এ মন্তব্য করে তিনি আর ও উল্লেখ করেন, আছিয়ার ধর্ষণের বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে ধর্ষকদের শাস্তির এক দৃষ্টান্ত স্থাপন হোক। বিচারহীনতা, বিচারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং দীর্ঘসূত্রতা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে যে ধ্বংসাবশেষ জায়গায় নিয়ে গিয়েছে, শিশু আছিয়ার ধর্ষকদের মৃত্যুদ- দেওয়ার মাধ্যমে সেই বিচার ব্যবস্থা আবার জেগে উঠুক।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে শিশুটির লাশ মাগুরায় গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। এ সময় শিশুটির ওপর বর্বর নিপীড়নকারীদের বিচার দাবিতে স্থানীয়রা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশকে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে। লাশবাহী হেলিকপ্টারে মাগুরা নোমান ময়দানে পৌঁছালে সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পরে নোমান ময়দানেই শিশুটির লাশের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধা সাড়ে সাতটায় তার লাশ নিয়ে যাওয়া হয়ে গ্রামের বাড়ি শ্রীপুর উপজেলার জারিয়া গ্রামে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে সোনাইকুন্ডি কবরস্থানে সেনা বাহিনী ও পুলিশের তত্বাবধানে দাফন করা হয়।

এদিকে মাগুরা ভায়না মোড়ে অবরোধ করে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে রেখেছে একদল ছাত্র জনতা। তাদের দাবি ধর্ষকদের তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। স্থানীয়রা অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে স্লোগান দেন। মানুষের ক্ষোভ ও ক্রোধ এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, বিক্ষোভ ঠেকাতে শহরজুড়ে পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হলেও এর মধ্যেও অভিযুক্ত আসামিদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে বিক্ষুদ্ধ জনতা। এ রিপোর্ট লেখার আগ পর্যন্ত অভিযুক্তদের বাড়িতে আগুন জ্বলছিলো। নিহতের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।

মাগুরা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহেদ হাসান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা এটা মেনে নিতে পারছি না। আমরা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে ধর্ষকদের কোনো আইনি সহায়তা দেওয়া হবে না। আমরা যত দ্রুত সম্ভব ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’

জেলা মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক লাবণী জামান বলেন, আমরা মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে ধর্ষকের অবিলম্বে ফাঁসির দাবি জানাচ্ছি। বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত জেলা মহিলা পরিষদ সর্বদা শিশুটির পরিবারের পাশে থাকবে।

মাগুরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ধর্ষকদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফাঁসি না দেওয়া হোক অন্যথায় তাহলে আমরা মাগুরায় বিক্ষোভ শুরু করব।’
এদিকে বোনের বাড়িতে ধর্ষণ ও নিপীড়নের শিকার শিশু আছিয়ার মৃত্যুতে গায়েবানা জানাজা আদায় করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল রাত ৮টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে এ গায়েবান জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক তারেক রেজা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. নিয়াজ আহমদ খানসহ প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী জানাজায় অংশগ্রহণ করেন।

জানাজার পূর্বে শিক্ষার্থীরা “তুমি কে আমি কে, আছিয়া, আছিয়া”, “বিচার বিচার বিচার চাই, আছিয়া হত্যার বিচার চাই”, “আছিয়া মরলো কেন, ইন্টেরিম জবাব দে”, “ আমার বোন কবরে, খুনি কেন বাহিরে?” “একশান টু একশান, ডাইরেক্ট একশান- ধর্ষকদের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট একশান”, “ ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, ধর্ষকদের ফাঁসি চাই” ইত্যাদি স্লোগান দেন। ভিসি চত্বরে জানাজা শেষে শিক্ষার্থীরা কফিন মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে গিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। এসময় আছিয়া হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি ‘ফাঁসি’র দাবি জানান শিক্ষার্থীরা।

শিশু আছিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান। এক বিবৃতিতে তারা একইসাথে আছিয়ার খুনি ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক প্রকাশ্য বিচারও দাবি করেছেন। তারা বলেন, আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আছিয়ার খুনি ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক প্রকাশ্য বিচার দাবি করছি এবং প্রচলিত নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন সংশোধন করে বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার দাবি জানাচ্ছি। যাতে এমন পাশবিক অপরাধ করার সাহস আর কেউ না করে। বিবৃতিতে তারা বলেন, আট বছরের শিশুকন্যা আছিয়ার নৃশংস ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা জাহেলি যুগের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। ইসলামে ধর্ষণকারীকে জনসম্মুখে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

উল্লেখ্য বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে বোনের শ্বশুরের কাছে গণ নিপীড়নের শিকার হয় ৮ বছরের শিশুটি। এতে সহায়তা করে শিশুটির বোনের স্বামী ও শ্বশুর। বোনের শাশুড়িও ধর্ষকদের রক্ষায় সহায়তা করে। এ ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
totoslotgacor
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
toto gacor
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot