সংবিধানের ওপরে সনদের প্রাধান্য খারাপ নজির

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করছে বিএনপি। দলটি বলেছে, সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামায় এই সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া উচিত হবে না। কোনো ডকুমেন্ট বা নথির অবস্থান সংবিধানের ওপরে হতে পারে না। এটি করা হলে ভবিষ্যতের জন্য খারাপ নজির হবে। এ ছাড়া জুলাই সনদ নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না বলে অঙ্গীকারনামায় যে কথা বলা হয়েছে, তাও গ্রহণযোগ্য নয়। দলটি মনে করে, এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা এসব বিষয়ে মত ব্যক্ত করেন।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার রাতে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। এর পর বিএনপির শীর্ষ নেতারা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেন। গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনে এর আগে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া প্রস্তাবগুলোর মধ্যে দু-একটি মৌলিক প্রস্তাবে বিএনপির ছাড় দেওয়ার আভাস পাওয়া গেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠক সূত্র আরও জানিয়েছে, জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া নিয়ে সামগ্রিকভাবে খুব বেশি আপত্তি নেই বিএনপির। সনদে উত্থাপিত ৮৪ দফার মধ্যে যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি এবং যেসব বিষয়ে দলগুলো ‘নোট অব ডিসেন্ট’দিয়েছে, সেগুলোর সমাধানের পথ কী হবে, তা নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে দলীয় মতামত তুলে ধরা হবে।
বিএনপি মনে করে, যেসব প্রস্তাবে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়– এমন বিষয়গুলো যে কোনো সময় অধ্যাদেশসহ সরকারের নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়নযোগ্য। যেগুলো সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সংসদ নেবে।
জুলাই জাতীয় সনদের প্রথম খসড়ায় সংবিধান সংশোধন ও যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো আগামী সংসদ গঠনের দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি ছিল। তবে পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়ায় সেই অঙ্গীকার নেই। জানা গেছে, বৈঠকে সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া নিয়ে প্রয়োজনীয় বিচার-বিশ্লেষণ শেষে দলীয় মতামত জানাতে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদসহ তিনজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অবশ্য বিএনপি যেসব মৌলিক প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’দিয়েছে, সেগুলোতে ছাড় দিতে চায় না। এর মধ্যে আছে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ব্যক্তি একই সঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন না, নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের ১০০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন– এ দুটি বিষয়।
বিএনপি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার কিছু ভারসাম্য আনতে রাজি। তবে এমন ভারসাম্য চায় না, যেখানে সরকারপ্রধানের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকবে না। দলটি মনে করে, সার্বিক বিবেচনায় সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতিকে ব্যাপকভাবে ক্ষমতায়িত করা হলে সংসদীয় গণতন্ত্র তেমন অর্থবহ থাকবে না। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা না থাকলে, সংসদীয় গণতন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়বে।
জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়ায় রাজনৈতিক দলগুলো কোন কোন প্রস্তাবে একমত হয়েছে এবং কোন প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’দিয়েছে, সেটা উল্লেখ করা হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনায় ১৯টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে বিএনপি ১২টিতে একমত হয়েছে এবং সাতটিতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে।
কিছু বিষয়ে আলোচনা না হলেও জুলাই সনদে রাখা হয়েছে: সালাহউদ্দিন আহমেদ
গতকাল রাজধানীর গুলশানে নিজ বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে সমালোচনা করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, কিছু কিছু বিষয় আলোচনা করা না হলেও তা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ার সূচনা ও ২, ৩, ৪ দফা নিয়ে বিএনপির আপত্তির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, খসড়া সনদের সূচনায় অসত্য তথ্য দেওয়া হয়েছে। সবকিছু পর্যালোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে মতামত পাঠাবে বিএনপি। আগামী সংসদ গঠনের দুই বছরের মধ্যে সংবিধান-সংক্রান্ত সংশোধনী পাস করার কথা বলা হলেও চূড়ান্ত খসড়ায় তা নেই।
সালাহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, জুলাই সনদে উত্থাপিত ৮৪ দফার মধ্যে যেসব দফায় সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে; যেসব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট এসেছে, সেগুলোর সুরাহা কীভাবে হবে এবং সংবিধান সংস্কারবিষয়ক যেসব কথা এসেছে, তার বাস্তবায়ন কীভাবে হবে— এসবের নিষ্পত্তি জরুরি। এসব কিছু পর্যালোচনা করে কমিশনকে মতামত জানাবে বিএনপি।
নির্বাচন নিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই হবে। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছেন। কমিশনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা খুব দৃঢ়ভাবে এ নিয়ে কথাও বলেছেন। এটা নিয়ে বিএনপির কোনো সংশয় নেই।