Bangladesh

পার্লামেন্ট ওয়াচ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ, সংসদে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের প্রশংসায় সর্বোচ্চ সময় ব্যয় : টিআইবি

একাদশ জাতীয় সংসদে সরকার দলীয় সংসদ সদস্যগণ প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা ও সরকারের বিভিন্ন অর্জনের প্রশংসায় সর্বোচ্চ সময় ব্যয় করেছে। এই বিষয় আলোচনায় ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ ও ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ সময়। এছাড়া বর্তমান সরকারের বিভিন্ন অর্জন এবং প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসায় ব্যয়িত হয় ১১ দশমিক ৯ শতাংশ সময় এবং সরকার ও অন্য দলের সমালোচনায় ব্যয়িত হয় ১১ দশমিক ৬ শতাংশ সময়। অন্যদিকে অন্যান্য বিরোধী দলের সদস্যরা মোট ব্যয়িত সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ সময় ব্যয় করেছে সরকারের সমালোচনায় ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া বিভিন্ন দাবি দাওয়া ও প্রস্তাবনায় ব্যয় হয় ২৫.৩ শতাংশ সময়। আর সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ সময়। গতকাল রোববার ট্রান্সপারেন্সি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। এ উপলক্ষে রাজধানীর ধানম-িতে টিআইবির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে “পার্লামেন্টওয়াচ; একাদশ জাতীয় সংসদ; ১ম হতে ২২তম অধিবেশন (জানুয়ারি ২০১৯-এপ্রিল ২০২৩)” শীর্ষক প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, প্রশ্নোত্তরে ও বাজেট আলোচনার বিষয়বস্তুর বাইরে অপ্রাসঙ্গিকভাবে সরকারি সাফল্য ও প্রশংসা এবং প্রতিপক্ষের সমালোচনায় সংসদের সময় ব্যয় হয়েছে কিন্তু জবাবদিহিতার উপাদান অনুপস্থিত থেকেছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা হলেও, এ বিষয়ে জবাবদিহিতা বা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা প্রফেসর ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন টিআইবির রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট রাবেয়া আক্তার কনিকা এবং মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান সাখিদার।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন জোটভুক্ত দল হিসেবে সংসদীয় কার্যক্রমে প্রধান বিরোধী দল দ্বৈত ভূমিকা পালন করেছে এবং সংসদকে কার্যকর করে তুলতে বিরোধী দলের শক্তিশালী ভূমিকা পালনে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিপরীতে প্রধান বিরোধীদলের অবস্থান ছিল প্রান্তিক এবং সরকারকে জবাবদিহি করার ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা ছিল সার্বিকভাবে গৌন।

এতে আরো বলা হয়, সংসদীয় কার্যক্রমে বিষয়ভিত্তিক, প্রাসঙ্গিক ও গঠনমূলক আলোচনার পরিবর্তে সরকার ও দলীয় অর্জন ও প্রশংসা এবং প্রতিপক্ষদলের প্রতি আক্রমনাত্মক সমালোচনার প্রাধান্য পেয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদে বিভিন্ন কার্যক্রমে ৭৪৪ ঘন্টা ১৩ মিনিট সময় ব্যয় হয়েছে, যার মধ্যে জনপ্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা কার্যক্রম মোট সময়ের ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ, প্রেসিডেন্টের ভাষণের উপর আলোচনা মোট সময়ের ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ, বাজেট আলোচনায় ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং কিছু বিশেষ কার্যক্রমে ১ দশমিক ২ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে।

টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রেসিডেন্টের ভাষণে প্রায় চার পঞ্চমাংশ (৮০ ভাগ) সময় সরকারের অর্জন বিষয়ক আলোচনাই প্রাধান্য পেয়েছে। প্রেসিডেন্টের ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব আলোচনায় সরকারদলীয় সদস্যরা সর্বোচ্চ সময় ব্যয় করেছেন প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা এবং সরকারের বিভিন্ন অর্জনের প্রশংসায়। একইভাবে, প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে ৪৮ দশমিক ৭ প্রশ্নকর্তা প্রশ্নের বাইরে অন্যান্য আলোচনা (প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা, দলের প্রশংসা, অন্য দলের সমালোচনা ইত্যাদি) করেন যা প্রশ্ন উত্থাপনে মোট ব্যয়িত সময়ের প্রায় ৮০ ভাগ। একইভাবে, মন্ত্রীদের প্রশ্নোত্তর পর্বে ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রশ্নকর্তা প্রশ্নের বাইরে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা, দলের প্রশংসা, অন্য দলের সমালোচনা করেন যা প্রশ্ন উত্থাপনে মোট ব্যয়িত সময়ের প্রায় ৬৫ ভাগ। অন্যদিকে উত্তর প্রদানের প্রায় ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ ব্যয় হয়েছে উত্তর বহির্ভূত আলোচনায়। একইভাবে, সাধারণ আলোচনায় একক ভাবে বঙ্গবন্ধু সংশ্লিষ্ট আলোচনায়ই প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি সময় ব্যয়িত হয়েছে যা শতাংশের হিসেবে ৪৫ দশমিক ১ শতাংশ। বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করতে গিয়ে সদস্যরা আত্মপ্রশংসা ও অন্যদলের সমালোচনায় ব্যয় করে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক কার্যক্রমসমূহে তুলনামূলক কম গুরুত্ব প্রদান (কার্যক্রম স্থগিত রাখা, চলমান জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ অনালোচিত থাকা ইত্যাদি) করা হয়েছে এবং সার্বিকভাবে বিগত সংসদগুলোর চেয়ে (নবম ও দশম সংসদ) ব্যয়িত সময় ও অংশগ্রহণের হার হ্রাস পেয়েছে। আইন প্রণয়নে সরকারি দলের অধিকাংশ সদস্যের অংশগ্রহণ শুধুমাত্র বিলের পক্ষে ভোট দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো।

গবেষণায় দেখা যায়, কোরাম সংকটে মোট ৫৪ ঘন্টা ৩৮ মিনিট ব্যয় হয় যা সংসদ কার্যক্রমের মোট ব্যয়িত সময়ের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। কার্যদিবস প্রতি গড়ে ১৪ মিনিট ০৮ সেকেন্ড ব্যয় হয়। ৮৪ শতাংশ কার্যদিবসে নির্ধারিত সময় হতে বিলম্বে অধিবেশন শুরু হয় এবং ১০০ শতাংশ কার্যদিবসে বিরতির পর নির্ধারিত সময় হতে বিলম্বে অধিবেশন শুরু হয়। সংসদ পরিচালনার প্রতি মিনিটের গড় অর্থমূল্য প্রায় ২ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৪ টাকা। এই হিসেবে কোরাম সংকটে ব্যয়িত সময়ের প্রাক্কলিত অর্থমূল্য প্রায় ৮৯ কোটি ২৮ লাখ ৮ হাজার ৭৭৯ টাকা।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংসদের মূল ভূমিকা- আইন প্রণয়ন, জনগনের প্রতিনিধিত্ব ও জনগণের পক্ষে সরকারের জবাদিহিতা নিশ্চিত করা। আনুষ্ঠানিকভাবে এ ভূমিকা পালনের সুযোগ থাকলেও, বাস্তবে ব্যাপক ঘাটতি উঠে এসেছে গবেষণায়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, একাদশ জাতীয় সংসদে একটি আইন পাশ হতে আন্তর্জাতিক চর্চার অনেক কম সময় লেগেছে। আইন প্রণয়নে কম সময় দেওয়ার অর্থ হচ্ছে চুলচেরা বিশ্লেষণে ঘাটতি রয়ে গেছে। বিশেষ করে আইন কতটুকু জনকল্যাণমুখী হলো, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থেকে সাইবার নিরাপত্তা আইনের রূপান্তর যার প্রকট উদাহরণ। অন্যদিকে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কার্যক্রমে ব্যাপক দুর্বলতা অব্যাহত রয়েছে। সংসদ কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী প্রতি মাসে একটি বৈঠক করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও, সবগুলো কমিটিগুলো তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, নির্বাচন নিয়ে জনমনে উদ্বেগ রয়েছে। কার্যকর সংসদ ও জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন, সরকার ও অন্যান্য অংশীজন যেমন- রাজনৈতিক দল, আইন-শৃখলা বাহিনী ও প্রশাসনসহ সবাইকে স্বার্থের দ্বন্দ্ব মুক্ত থেকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। জাতীয় সংসদের প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন নিশ্চিতে ১৩ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button