International

ডিজিটাল মুদ্রার সুবিধা–অসুবিধা বোঝার জন্য ৪টি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

মোবাইল ফোন স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে জিডিটাল ইউয়ানের জন্য চীনের সরকারি অ্যাপ। পাশেই রাখা ১০০ ইউয়ানের একটি ব্যাংকনোট

ডিজিটাল মুদ্রার কথা বললেই অনেকের মনেই বিটকয়েনের মতো একটি ক্রিপ্টোকারেন্সির চিত্র ভেসে ওঠে। তবে ডিজিটাল মুদ্রা বা কারেন্সি ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে বেশ খানিকটা ভিন্ন।

বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, জুনের শেষে ইউরোপীয় কমিশন ডিজিটাল ইউরো চালু করতে একটি প্রস্তাব পেশ করেছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, একটি ডিজিটাল ইউরোর মূল্যমান হবে বর্তমানে প্রচলিত ইউরোর একবারে সমান। এই ডিজিটাল মুদ্রা বাজারে ছাড়বে, অথবা বলা ভালো চালু করবে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা ইসিবি।

ফলে ডিজিটাল ইউরোর মর্যাদা বা অবস্থান হবে আনুষ্ঠানিক, অর্থাৎ এটি হবে এমন একটি মুদ্রা, যাকে আপনি দাপ্তরিক বা সরকারি, যেভাবেই বর্ণনা করেন না কেন। ঠিক যেমন মর্যাদা রয়েছে প্রচলিত ইউরো মুদ্রার, যাকে আপনি হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারেন।

ঠিক এ কারণেই ডিজিটাল মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে ভিন্ন। ক্রিপ্টোকারেন্সি কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ছাড়ে না এবং তাদের মূল্য সারাক্ষণই পরিবর্তিত হচ্ছে। ঝুঁকি গ্রহণ করতে রাজি এমন অনেক বিনিয়োগকারী ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনাবেচায় অংশ নিচ্ছেন। ঝুঁকি এ কারণে যে এই হয়তো ক্রিপ্টোকারেন্সির দাম বাড়ল, এই আবার তা খাদে নেমে গেল।

পৃথিবীর অনেক দেশই কিন্তু ডিজিটাল মুদ্রা চালু করেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সির মূল্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করে না। অন্যদিকে ডিজিটাল মুদ্রা কাজ করে দাপ্তরিক মুদ্রার মতোই। পার্থক্য কেবল, এটি প্রচলিত মুদ্রার একটি ইলেকট্রনিক ধরন।

ডিজিটাল মুদ্রা সম্পর্কে চারটি তথ্য যা আপনাকে সাহায্য করবে এর কাজ বুঝতে ও এর সুবিধা কিংবা অসুবিধাগুলোই–বা কী।

১. যেভাবে এটি কাজ করে

প্রচলিত মুদ্রার ইলেকট্রনিক সংস্করণ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রার প্রচলন করে। মানুষ প্রতিদিন যেসব মুদ্রা ব্যবহার করে যেমন টাকা, ডলার, ইউরো কিংবা ইউয়ান, সেসব কাগুজে বা ধাতব মুদ্রার ডিজিটাল সংস্করণ এই মুদ্রা।

তার মানে হলো কাগজে না ছেপে বা ধাতুর কয়েন না বানিয়ে একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নিজের প্রচলন করা মুদ্রা ইলেকট্রনিক সংস্করণে বাজারে ছাড়ে।

একটি পার্থক্য হলো এসব মুদ্রা আপনার হাতে আসার জন্য কোনো মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ ব্যাংকের দরকার নেই। তাত্ত্বিকভাবে, আপনি যেভাবে আরেকজনের সঙ্গে কাগুজে মুদ্রা বিনিময় করেন, ঠিক একইভাবে ডিজিটাল মুদ্রার ইলেকট্রনিক বিনিময় করবেন।

বাণিজ্যিক ব্যাংকে অনলাইনে মুদ্রা বিনিময়ের একটা খরচ আছে। ডিজিটাল মুদ্রা সেই খরচ কমিয়ে আনবে বলে মনে করা হয়। আরও প্রত্যাশা, এটি কম আয়ের মানুষ ও ব্যাংকসেবার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য সুবিধাজনক হবে।

কিছু বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিচ্ছেন, ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহারের জন্য সবাইকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হিসাব খুলতে। তবে এটা প্রতিটি দেশ কিংবা মুদ্রা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তবে ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে এবং বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলো সুবিধা-অসুবিধার দিকগুলো খতিয়ে দেখছে।

২. ডিজিটাল মুদ্রা কোথায় আছে

চীন হলো সবচেয়ে বড় অর্থনীতি, যারা নিজের দেশের কিছু অংশে ২০২০ সালেই ডিজিটাল মুদ্রা চালু করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২৬ কোটি মানুষ বর্তমানে ডিজিটাল ইউয়ান ব্যবহার করছেন। বেইজিংয়ে সরকারের পরিকল্পনা আছে, ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার পুরো দেশে চালু করার।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের তথ্য জানাচ্ছে, সব মিলিয়ে ১৩০টি দেশ ডিজিটাল মুদ্রা চালুর সম্ভাবনার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। তাদের মধ্যে অর্ধেকের মতো দেশ এ ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে গেছে—হয় তারা পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেছে কিংবা পুরোপুরি চালু করার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে।

আর্জেন্টিনা বাদে জি২০-ভুক্ত দেশগুলোর সবাই এ ধরনের কোনো না কোনো প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। ১১টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে ডিজিটাল মুদ্রার প্রচলন বা চালু করেছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে নাইজেরিয়া এবং বেশ কয়েকটি ক্যারিবীয় দেশ।
শুরু বাহামা দ্বীপপুঞ্জের হাতে। ছোট একটি দেশ, জনসংখ্যা মাত্র ৩ লাখ ৯০ হাজার।

কোন একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রচলন করা ডিজিটাল মুদ্রা পৃথিবীর মধ্যে সে দেশেই প্রথম চালু হয়েছে। এটির নাম ‘স্যান্ড ডলার’। তবে উদ্যোগটি সেখানে চলছে খুব ধীরগতিতে। কারণ, জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই এটি ব্যবহার করেন না। বাকি সব দেশকেই অবশ্য একই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

দুটো বড় অর্থনীতির দেশ, ভারত ও ব্রাজিল পরিকল্পনা করছে কয়েক বছরের মধ্যে ডিজিটাল মুদ্রা চালু করতে। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য ডিজিটাল ডলার চালু করার ধারেকাছেও নেই। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২২ সালের মার্চে কর্মকর্তাদের মাত্র নির্দেশ দিয়েছেন, ডিজিটাল ডলার চালু করার সুবিধা-অসুবিধা কী, তা খতিয়ে দেখতে। তবে দেশটির অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় ডিজিটাল ডলারের বিষয়টি নেই।

সুইডেনে একটি পাইলট কর্মসূচি চলছে। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড এই দশকের শেষ নাগাদ ডিজিটাল পাউন্ড চালু করতে কাজ করছে। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও রাশিয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ে।

অফিশিয়াল মুদ্রা নিয়ে অনেক দেশে শুরুতে আগ্রহ থাকলেও ধীরে ধীরে এর ব্যবহার কমে গেছে; এমন একটি দেশ নাইজেরিয়া। সেনেগাল ও ইকুয়েডর ডিজিটাল মুদ্রা চালু করার পরিকল্পনাই বাতিল করেছে।

৩. সম্ভাব্য সুবিধাগুলো কী

ডিজিটাল মুদ্রার পক্ষের মানুষেরা বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংক সুবিধার বাইরে যাঁরা রয়েছেন, ডিজিটাল মুদ্রা তাঁদেরকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে নিয়ে আসবে; সঙ্গে ঘটবে প্রযুক্তির উদ্ভাবন, বিনিময়ের দক্ষতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন।

তাত্ত্বিকভাবে খরচ কমবে। কারণ, ডিজিটাল মুদ্রার জন্য কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রয়োজন হবে না। সব লেনদেন হবে সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে।

এ ছাড়া মনে করা হচ্ছে যে ডিজিটাল মুদ্রা কিছু ধরনের আর্থিক অপরাধ ঠেকাতে সাহায্য করবে। কারণ, এটা সহজেই জানা যাবে একটি মুদ্রা কে পাঠিয়েছে কিংবা কে গ্রহণ করেছে।

৪. ব্যবহারকারীর ঝুঁকি কী

ইউরোর ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, আগামী বছরগুলোয় একটি ডিজিটাল মুদ্রা তৈরি হলে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটি ব্যবহারের জন্য কোনো ফি বা মাশুল আরোপ করবে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার বিনা মূল্যে করা যাবে। মাঝখান থেকে বিদেশি মুদ্রার লেনদেন যারা করবে, তারা কী ধরনের ফি আরোপ করবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

এ ছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে এর সম্পর্ক কী হবে, সেটিও এখনো স্পষ্ট নয়। সমালোচকেরা সতর্ক এ কারণে যে যেসব দেশে স্বচ্ছতায় ঘাটতি রয়েছে, সেসব দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে লেনদেনের সব তথ্য থাকবে এবং এসব তথ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতে পারে।

অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো উদ্বিগ্ন যে বিপুলসংখ্যক আমানতকারী ব্যাংকব্যবস্থা থেকেই চলে যাবেন, ফলে তাঁদের ব্যবসা ঝুঁকিতে পড়বে। পরিস্থিতি খারাপ হলে অনেক ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক পড়ে যাবে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একজন গ্রাহক কী পরিমাণ ডিজিটাল মুদ্রা রাখতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট কোনো মাধ্যমে সম্ভাব্য ঝুঁকি কমিয়ে আনা যায়।

আরেকটি সমালোচনা হলো যেহেতু সব কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীয়ভাবে হবে, তাই এমন ঝুঁকি রয়েছে যে একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত নেবে। কারণ, একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক চোখের পলকে মুদ্রা তৈরি করতে বা অপসারিত করতে পারবে।
অন্যদিক থেকে আরেকটি ঝুঁকি রয়েছে। ধরা যাক, বিদেশি কোনো একটি ডিজিটাল মুদ্রা খুব ভালোভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয়। সেই ভালো মুদ্রাটি স্থানীয় ডিজিটাল মুদ্রার বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা তাই বলেন, একটি দেশ যে মডেলে ডিজিটাল মুদ্রা প্রচলন করবে, তা বাস্তবায়ন কতটা ভালোভাবে হবে, শেষ পর্যন্ত তার ওপর নির্ভর করবে এর সাফল্য।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button