তামাশা: ভাত দেয়ার মুরোদ নাই, কিল দেয়ার গোঁসাই ’-বাংলা এই প্রবাদটিই যেন সত্য হয়ে এসেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি নির্দেশনায়
‘ভাত দেয়ার মুরোদ নাই, কিল দেয়ার গোঁসাই ’-বাংলা এই প্রবাদটিই যেন সত্য হয়ে এসেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি নির্দেশনায়। রোববার এক নির্দেশনায় ডেঙ্গু রোগীদের ঢাকায় আসতে বারণ করা হয়েছে অধিদপ্তরের ওই নির্দেশনায়। বলা হয়েছে উপজেলা এবং জেলার রোগীরা যাতে ঢাকায় না আসেন। জেলা এবং উপজেলায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও অধিদপ্তর জানিয়েছে।
অধিদপ্তর এই নির্দেশনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিকিৎসা না পেয়েই রোগীরা ঢাকা আসতে বাধ্য হচ্ছেন। এমন অবস্থায় তাদের ঢাকায় আসতে বারণ করা এক ধরণের তামাশা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা জারির পর গতকাল মানবজমিন এর পক্ষ থেকে ডেঙ্গু প্রবণ জেলা এবং উপজেলা থেকে আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় গুরুতর রোগীদের নিয়ে স্বজনরা ছুটছেন বিভাগীয় শহর বা রাজধানীতে। চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে আছে ওষুধ এবং স্যালাইন সংকটও। কয়েকজন সিভিল সার্জন মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ডেঙ্গু রোগীদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা অনেক হাসপাতালে নেই। মানুষ বাধ্য হয়েই বিভাগীয় শহর বা ঢাকায় যাচ্ছেন।
অনেক ক্ষেত্রে জেলা বা উপজেলা থেকে রোগীকে রেফারও করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে মানুষকে এভাবে নির্দেশনা দেয়া হাস্যকর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, একজন রোগীর অধিকার আছে, তার ইচ্ছা অনুযায়ী চিকিৎসা নেয়ার। সেখানে আপনে তাকে বাঁধা দিতে পারেন না। সরকার পেরিপেরিতে (উপজেলায় পর্যায়ে) ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা না করে এই ধরনের নির্দেশনা দিতে পারে না। মানুষ এমনিতেই অনেক কষ্টে আছেন। তার উপর ডেঙ্গু রোগের ভোগান্তি। মানুষ ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসবেই। এটা ঠেকানো উচিৎ নয়।
মাগুরা সিভিল সার্জন ডা. মো. শামীম কবির বলেন, ডেঙ্গুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্লাটিলেট কমে যাওয়া। তাই অধিদপ্তরের নির্দেশ মতো আমরা আমাদের র্যাপিড রেসপন্স টিমের মাধ্যমে রোগির অবস্থা যেন মারাত্মক রুপ ধারণ না করে সেই দিকে নজর দিচ্ছি। কারণ রোগির অবস্থা বেগতিক হলে তাকে ঢাকা পাঠানোর আগেই এক্সপায়ার করে। হস্তান্তরের সময় থাকে না। তবে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ঘাটতির বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, আমাদের সব সরকারি হাসপাতোলেই ধারণ ক্ষমতার অধিক রোগী ভর্তি থাকে। তাই সকলকে সমান সুবিধা দেয়া দেয়া যায় না। রোগির মারাত্মক কিছু হলে জেলা পর্যায়ে আইসিইউ না থাকায় তেমন কিছু করা সম্ভব নয় বলেও হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন, এরপর আমি সদ্য যোগদান করে আমাদের চিকিৎসক ও ওষুধ পরিবেশকসহ বিভিন্নমহলকে সঙ্গে নিয়ে সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এরপরও অনেকে তাদের সাধ্যমতো ঢাকাসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে রোগিকে নিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন।
ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন ডা শুভ্রা রাণী দেব নাথ বলেন, আমাদের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে হাসপাতালে রোগি বেশি। ঢাকায় রোগি না পাঠানোর বিষয়ে তিনি বলেন, সাধারণ রোগিকে ঢাকা পাঠাতে নিরুৎসাহি করা হয়েছে। তবে যদি কোনো ডেঙ্গু রোগির কিডনি কাজ করছে না, হার্টে সমস্যা দেখা দিয়েছে সেইসব মুমুর্ষ রোগিকে ঢাকা পাঠানো যাবে। কারণ তাদের আইসিইউ লাগবে। যার ব্যবস্থা আমাদের এখানে নেই। ঝিনাইদহে স্যালাইন, বেডের সংকট রয়েছে বলেও জানান তিনি।
প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। হাসপাতালের নির্ধারিত শয্যার বাইরে মেঝে ও বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন নিজ বাড়িতেই। তবে ডেঙ্গু রোগীর প্রয়োজনীয় স্যালাইন সংকটে বিপাকে পড়তে হচ্ছে রোগী ও স্বজনদের। হাসপাতালে নেই সরবরাহ, বাড়তি দামেও ফার্মেসিতে মিলছে না স্যালাইন। শেরপুর সিভিলসার্জন ডা. অনুপ ভট্টাচার্য্য বলেন, বেড, স্যালাইন, চিকিৎসক থাকলেও কিন্তু আমাদের জেলাপর্যায়ে ডেঙ্গু রোগির চিকিৎসার জন্য পর্যপ্ত সুযোগ সুবিধা থাকে না। ডেঙ্গু রোগির প্লাটিলেট কমে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের আইসিইউ এর প্রয়োজন হয়। সেই আইসিইউ ব্যবস্থা কিন্তু আমাদের বেশিরভাগ জেলা হাসপাতালেই নেই। থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। তাই অনেক সময় বাধ্য হয়ে আমাদের রোগিকে রেফার করতে হয়। তা না হলে তার জীবন সংকটে পরে। তখন স্বজনরা আমাদেরকেই দোষ দেন।
মাগুরা ২৫০ শয্যা সদর হাসাপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় ৬৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। জেলার ৪ উপজেলায় বর্তমানে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে মোট ১২২ জন । এর মধ্যে সদরে ভর্তি ৭৩ জন, শ্রীপুরে ২৪ জন, মহম্মদপুরে ২৩ জন ও শালিখায় ২ জন । গতকাল সোমবার সরজমিন মাগুরা সদর হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ৭৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি থাকলেও সদর হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে সাধারণ বেডের সংখ্যা রয়েছে ৪০টি। ফ্লোরে অবস্থান করছেন বাড়তি রোগীরা। নেই কোন আইসিউ’এর ব্যবস্থাও। স্যালাইনও পর্যাপ্ত না।
জেলায় আগের তুলনায় কয়েকগুন বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। বিভিন্ন উপজেলা থেকে গত ২৪ ঘন্টায় ৯৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন জেলা সদর হাসপাতালে। তবে ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে ডেঙ্গু বেরাগীর জন্য নেই আলাদা কোনো শয্যা ব্যবস্থা। অনেকেই হাসপাতালের ফ্লোরে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। রয়েছে স্যালাইনের সংকটও। সিনিয়ার কনসালটেন্ট না থাকায় জীবন বাঁচানোর তাগিদে রোগী নিয়ে অনেকেই ছুটছেন ঢাকায়। এবিষয়ে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. রেজাউল ইসলাম বলেন, সাধারণ ডেঙ্গু রোগির চিকিৎসা আমরা এখান থেকেই দিয়ে থাকি। পারতপক্ষে কোনো রোগীকে ঢাকায় রেফার করি না। কিন্তু ক্রিটিক্যাল মোমেন্টে যখন আমরা সেবা দিতে পারছি না সেটা আমরা কি করবো? তাকে রেখে তো আমরা মেরে ফেলতে পারি না। এসব রোগির চিকিৎসার জন্য সর্বপ্রথম একজন অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। যা আমাদের নেই। আইসিইউ নেই। তেমন কোনো পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নেই। যেমন প্লাটিলেট সিস্টেমসহ তেমন বিশেষ ব্যবস্থা আমাদের নেই। আলাদা ইউনিট না থাকায় ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ফ্লোরিং বেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে যেই রোগিকে আমরা এখানে সার্বিক চিকিৎসা দিতে পারবো না, তাকেতো রেফার করতেই হবে।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু রোগির সংখ্যা। আইসিইউ ও সুযোগ সুবিধা থাকা সত্বেও তা পর্যাপ্ত না হওয়ায় অনেকেই আশেপাশের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেকে আবার বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে অবস্থার বেগতি হলে রোগীকে নিয়ে ছুটছেন ঢাকা মেডিকেলসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে।
ফরিদপুরে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ২৬৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৮০২ জন। জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আট হাজার ১৬৩ জন। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৩০ জন রোগী। হাসপাতালগুলোতে চলছে শয্যা সংকট। অনেক রোগীকে মেঝেতে-বারান্দায়, রাস্তায় বিছানা পেতে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে চরম সংকট দেখা দিয়েছে স্যালাইনের। বাইরে থেকে স্যালাইন কিনতে রোগীর স্বজনদের নাভিশ্বাস অবস্থা। বাড়তি দামে ফার্মেসিতেও মিলছে না কোনো স্যালাইন।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রক্তের জলীয় অংশ কমে যায়। এতে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তচাপ কমে যায়। রক্তের তারল্য ঠিক রাখতে ও রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে রোগীকে স্যালাইন দিতে হয়। একজন রোগীকে দিনে এক থেকে দুই লিটার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর বেশি স্যালাইন দেয়ার প্রয়োজন হয়। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় সাধারণত দশমিক ৯ শতাংশ সোডিয়াম ক্লোরাইড স্যালাইন রোগীর শরীরে পুশ করতে হয়। আর এসব সুযোগ সুবিধা না পাওয়ায় ও রোগীর জীবন সংকটপন্ন হওয়ায় অনেকেই রোগি নিয়ে ছুটছেন ঢাকায়।
ডেঙ্গু নিয়ে পঞ্চগড়ে জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ৪৮ ঘন্টায় সদর উপজেলায় ২ জন, দেবীগঞ্জ উপজেলায় ৩ জন ও তেঁতুলিয়া উপজেলায় ১ জন ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত হয়েছে। এছাড়া ২৪ ঘন্টায় সদরে আরও ১ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। এরা সবাই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। পঞ্চগড় সিভিল সার্জন ডা. মোস্তফা জামান চৌধুরী বলেন, এ জেলার হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই। তবে স্থানীয়ভাবে আমরা চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করছি। এরপরও রোগির আশঙ্কজনক অবস্থা হলে আমরা রংপুরে রেফার করে থাকি।