দেশে শিক্ষিত বেকার ২৩ লাখ ৫০ হাজার: বিবিএস
ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করে ছয় বছর ধরে চাকরির পেছনে ছুটছেন রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা ফখরুল ইসলাম। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, বেসরকারি ব্যাংক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরির চেষ্টা করেছেন। কোথাও চাকরি মেলেনি। এত দিনে আবেদনের বয়স শেষ।
এখন বিদেশ যাওয়ার কথা ভাবছেন।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, ৩০ দিন ধরে কাজপ্রত্যাশী একজন মানুষ যদি শেষের সাত দিনে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ না পান, তাহলে তাঁকে বেকার হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোও (বিবিএস) এই সংজ্ঞা ব্যবহার করে। কিন্তু সে অর্থে চাকরি না থাকলেও ফখরুলকে বেকার বলা যাবে না। কারণ তাঁর প্রাইভেট টিউশনি আছে।
ফখরুলের ভাষ্য, ‘তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী আমি বেকার নই। আমি তো টিউশনি থেকে মাসে ছয় হাজার টাকা পাই। এই টাকা দিয়ে আমার পকেট খরচই চলে না, আর তো জীবন! শতাধিক চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি।
এখন আবেদনের আর বয়স নেই। তাই বিদেশ যাওয়ার কথা ভাবছি।’
একই গল্প কুষ্টিয়ার রেশমার। তিনিও স্নাককোত্তর। চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত রেশমা বলেন, ‘চাকরির জন্য বিভিন্ন পোশাক কারখানায় ঘুরেছি।
কাজ হয়নি। এখন গ্রামে এসে দুটি বাচ্চা পড়াই। অথচ মা-বাবা কত আশা নিয়েই না পড়িয়েছেন!’
বিবিএসের সংজ্ঞা অনুযায়ী রেশমাও বেকার নন। কিন্তু সমাজে প্রচলিত অর্থে তিনি বেকার। কারণ বাস্তবে তাঁর প্রতি মাসে বেতন পাওয়ার মতো চাকরি নেই কিংবা নিয়মিত আয়ের কোনো সংস্থান নেই।
বিবিএসের তথ্য মতে, দেশে মোট বেকারের ১২ শতাংশই এমন উচ্চশিক্ষিত। অথচ যাঁদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাঁদের বেকারত্বের হার মাত্র ১.০৭ শতাংশ। অর্থাৎ মানসম্মত শিক্ষার অভাবে দেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অধিক হারে বাড়ছে।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করা বেকারের হার ৮.৭৮ শতাংশ। মাধ্যমিক শেষ করা বেকার ২.৪২ শতাংশ। প্রাথমিক শেষ করা বেকারের হার ১.৬৯ শতাংশ। অন্য কোনো মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করা ব্যক্তিদের বেকারত্বের হার ৪.৮৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করা ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছেন। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনো অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩ শতাংশ নিজ উদ্যোগে কিছু করছেন।
লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্য মতে, বাংলাদেশে ১০০ জন স্নাতকধারীর ৪৭ জনই বেকার। আইএলওর ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা তিন কোটি। তখন সংস্থাটি আভাস দেয়, কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ছয় কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯.৪০ শতাংশ হবে।
এদিকে উচ্চশিক্ষিত হয়েও চাকরি না পেয়ে হতাশ দেশের যুবসমাজ। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থ-সামাজিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তাঁরা চাকরি পাবেন না। গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ। চাকরি, পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণ নেই ২৯.৮ শতাংশ তরুণের।
বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর হিসাব বলছে, দেশে শ্রমশক্তির মোট পরিমাণ সাত কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে কাজ করছেন সাত কোটি চার লাখ ৭০ হাজার জন। অর্থাৎ দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৮০ হাজার। আর ২০২৩-এর চতুর্থ কোয়ার্টারের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে বেকার ২৩ লাখ ৫০ হাজার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বেকারত্বের হিসাবের এই পদ্ধতিতে গলদ আছে। এই সংজ্ঞা বাংলাদেশে বেকারত্বের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য আংশিক কর্মসংস্থান সম্পর্কিত ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং এই সংজ্ঞা দেশের মোট উৎপাদনের অন্যান্য উপাদানের মধ্যকার মৌলিক ভারসাম্যহীনতাকেই প্রতিফলিত করে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহম্মদ মইনুল ইসলাম বলেন, বিবিএস বেকারত্বের যে হিসাব দেয়, তা সঠিক নয়। তাদের সংজ্ঞা বাংলাদেশে বেকারত্বের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য আংশিক কর্মসংস্থান সম্পর্কিত ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই বেকারত্বের সঠিক সংজ্ঞা নিরূপণ এবং তা চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তথ্য-উপাত্তকে সংস্কারের অংশ হিসেবে সামনে আনা জরুরি।
উচ্চশিক্ষা নিয়েও বেকার থাকার বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আপডেট হয় না। এটা নিয়মিত পরিবর্তন প্রয়োজন। লেখাপড়া শুধু পরীক্ষা আর ডিগ্রিকেন্দ্রিক হলে হবে না। লেখাপড়া হতে হবে জ্ঞানকেন্দ্রিক। যেটা পড়বে, সে ব্যাপারে ল্যাবে প্র্যাকটিক্যালও করতে হবে। আমাদের স্টুডেন্টদের দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। শুধু শিক্ষা কাজে লাগছে না। এ জন্য আমাদের কারিকুলাম আপডেট করতে হবে। ওই মানের শিক্ষকও তৈরি করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থারও পরিবর্তন দরকার। আমরা আধুনিক শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে। এ জন্য যাঁরা এই খাত পরিচালনা করছেন, তাঁদেরও পরিবর্তন দরকার।’
এ বিষয়ে চাকরির অন্যতম অনলাইন মার্কেট বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এ কে এম ফাহিম মাসরুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতি মাসেই চার-পাঁচ লাখ আবেদন আসে আমাদের ওয়েবসাইটে। যাঁদের কোনো দক্ষতা আছে তাঁদের চাকরি পেতে দেরি হয় না। দক্ষতা না থাকলে অনেক দিন বেকার হিসেবে পড়ে থাকেন। বারবার আবেদন করেন। আসলে চাকরির বাজারে কম্পানিগুলোতে এত গ্র্যাজুয়েটের প্রয়োজন নেই। তাদের বেশি শ্রমিক দরকার। এ জন্য যেকোনো কম্পানি বা কাজ টার্গেট করে ট্রেনিং নেওয়া উচিত। তাহলে চাকরি পাওয়া সহজ হয়।’
এ বিষয়ে দেশের অন্যতম শিল্প গ্রুপ প্রাণ-আরএফএলের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী বলেন, শিক্ষিতদের বড় সমস্যা হলো তাঁরা কায়িক পরিশ্রমের কাজ করতে চান না। তাঁরা সবাই বসে কাজ করতে চান। একটি অফিসে সবাই যদি অফিসারের মতো বসে থাকতে চান, তাহলে প্রডাকশনের কাজ করবেন কে? আমাদের তো বেশি শ্রমিক দরকার। তাই ডিগ্রি থাকলেও সব ধরনের কাজের মানসিকতা থাকতে হবে।’
উচ্চশিক্ষিত বেকারদের জন্য সরকার কী উদ্যোগ নিচ্ছে বা নেওয়া উচিত, জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সচিব মামুন-আল-রশীদ বলেন, ‘সরকার তাঁদের সর্বোচ্চ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দিয়েছে, আর কী দিতে পারে। সরকার কম শিক্ষিতদের জন্য বিভিন্ন কারিগরি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করছে, প্রকল্প নিচ্ছে। বেকার বেড়ে যাওয়ায় চীন যেমন উচ্চশিক্ষা বন্ধ করে কারিগরি শিক্ষা চালু করেছিল, সরকারেরও এখন সেটা করা উচিত। যদিও সেটা করা সরকারের জন্য কঠিন। তবে আমাদের যেসব বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়, তার পরিবর্তে কর্মমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। এখানে কিছু বিষয়ে যে শিক্ষা দেওয়া হয়, সে অনুযায়ী বাজারে কর্ম নেই।’