Hot

সচিব মামার দাপটে দুই ভাগনের লুটপাট

‘মামা-ভাগনে যেখানে আপদ নাই সেখানে’– চেনা প্রবাদটির মতো কোনো ঝুট-ঝামেলা ছাড়াই ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র নিয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির পথে হেঁটেছেন সচিব মামা আর দুই ভাগনে। কর্মসংস্থান ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. সায়েদুল ইসলাম গেল ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব। তাঁর গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া সদরের কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের বেলঘরিয়ায়। সাবেক এই সচিবের ১১ বোন। এর মধ্যে দু’জনের বিয়ে হয়েছে কুমারখালীর দুই গ্রামে। সায়েদুল ইসলামের দুই ভাগনের একজন ইলিয়াছ খান খসরু, আরেকজন নওশের আলী সজীব। মামা যখন সচিব ছিলেন, তখন কুষ্টিয়া কৃষি বিভাগ ছিল দুই ভাগনের হাতের মুঠোয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কুষ্টিয়ার ছয় উপজেলায় সরকারের ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পের ভর্তুকির কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণে বড় মাপের যে ঘাপলা হয়েছে, এর নেপথ্যের কুশীলব সচিবের এ দুই স্বজন। শুধু দুই ভাগনেই নন, সুযোগ কাজে লাগাতে ভুল করেননি সচিবও। তিনি সরকারের শীর্ষ কর্তা হয়েও নিয়মের ধার না ধেরে প্রকৃত কৃষকের জন্য বরাদ্দের কৃষিযন্ত্রের তিনটি ভর্তুকি দরে নিজের নামে কেনেন।
নয়ছয় করে উপকারভোগীর তালিকা তৈরি, ভুয়া এনআইডি কার্ডে যন্ত্র উত্তোলন, কাগজে-কলমে যন্ত্র উত্তোলন দেখিয়ে ভর্তুকির টাকা আত্মসাৎ, নিম্নমানের যন্ত্র সরবরাহ, কৃষকদের কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়া, গোপনে যন্ত্র বিক্রি করে দেওয়া, বিক্রয়-পরবর্তী সেবা না দেওয়া– হেন কোনো অনিয়ম নেই, যা এই প্রকল্প ঘিরে কুষ্টিয়ায় হয়নি।

ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র সরবরাহের নামে কোম্পানি, দালাল ও অসাধু কয়েকজন কর্মকর্তা লুটে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। কৃষককে ভুল বুঝিয়ে গছিয়ে দেওয়া হয় নিম্নমানের যন্ত্র। কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়ে কৃষকদের উৎপাদন খরচ ও সময় বাঁচানো ছিল এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। তবে নানা গোঁজামিলে সরকারের এ উদ্যোগ মাঠে মারা গেছে। সমকালের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এই মহাদুর্নীতির আদ্যোপান্ত।

বড় প্রকল্পে বড় দুর্নীতি

সরকার সারাদেশে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার এ প্রকল্প হাতে নেয় ২০২০ সালে। চলবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। মাঝপথে এসে প্রকল্পটি ঘিরে কম জল ঘোলা হয়নি! বিভিন্ন জেলার অনিয়মের অভিযোগ জমা পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। অভিযোগ তদন্তের জন্য দুদক কৃষি মন্ত্রণালয়ে নথি পাঠালেও কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে গরজ নেই। গত ৩০ জুন প্রকাশিত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনেও এ প্রকল্পের দুর্নীতির নানা খুঁটিনাটি বেরিয়ে আসে। কৃষিমন্ত্রী থেকে শুরু করে সচিব, কর্মকর্তা কেউই প্রকল্পটি নিয়ে স্বস্তিতে নেই।

কুষ্টিয়ায় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দায়িত্বে ৩৫টির বেশি কোম্পানি। যন্ত্র বিতরণের জন্য প্রথমে কৃষকদের কাছ থেকে আবেদন নিয়ে তালিকা প্রস্তুত করা হয়। সেই তালিকা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনুমোদন দিয়ে ঢাকায় পাঠান। সর্বশেষ প্রকল্প পরিচালক সেটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। যন্ত্র বিতরণে বেশি দুই নম্বরি হয়েছে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। উপজেলার চাঁদপুর, পান্টি, বাগুলাট ও চাঁপড়া ইউনিয়নে যন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এই চার ইউনিয়নে যন্ত্র সরবরাহ করে দুই ভাগনের ‘সিন্ডিকেট’। সেসব যন্ত্রপাতির বেশির ভাগ কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে নেই। কৃষক, কোম্পানির প্রতিনিধি আর দালাল মিলেমিশে সরকারি টাকা তুলে ভাগ করে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় সচিবের বাড়ি হওয়ায় সেখানেও হয়েছে যন্ত্রের নয়ছয়।

সচিব নিয়েছেন ভর্তুকির তিন যন্ত্র

ভর্তুকি দামে কৃষিযন্ত্র পাওয়ার কথা কৃষকের, তাও একটির বেশি নয়। তবে গত ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাওয়া কৃষি সচিব সায়েদুল ইসলাম নিজেই তিনটি যন্ত্র বাগিয়ে নেন। যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে– সিডার (চাষ ও বীজ বপন যন্ত্র), মেইজ সেলার (ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র) ও পাওয়ার স্পেয়ার (কীটনাশক প্রয়োগ যন্ত্র)। সরকারের ১ লাখ টাকা ভর্তুকি বাদ দিয়ে সিডারটি তিনি কেনেন ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায়। মেইজ সেলারের ক্ষেত্রে ভর্তুকি পেয়েছেন ৪২ হাজার ৫০০ টাকা। যন্ত্রটির দাম পড়ে ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা। পাওয়ার স্পেয়ার যন্ত্রটি ২৫ হাজার টাকা ভর্তুকি বাদ দিয়ে কিনেছেন ২৫ হাজার টাকায়।

গত ৩০ এপ্রিল ঢাকার খামারবাড়ি থেকে যন্ত্র তিনটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেন প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম। যন্ত্রের জন্য তিনি আগেই আবেদন করেছিলেন। যখন অনুমোদন হয়, তখন তিনি সচিব পদ থেকে অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে (পিআরএল) থাকলেও পরের মাসেই কর্মসংস্থান ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। অনুমোদন পেয়ে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সচিবের ভাগনে নওশের আলী সজীব যন্ত্র তিনটি মামার বাসায় পৌঁছে দেন। শুধু নিজের নামে নয়, বোন ও বোন জামাইয়ের নামেও কৃষিযন্ত্র পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন সচিব।

গত ২০ আগস্ট সাবেক সচিবের কুষ্টিয়া সদরের বেলঘরিয়া গ্রামের আলিশান বিশাল বাগানবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আঙিনাজুড়ে চলছে চাষবাস। বেগুনের পাশাপাশি হচ্ছে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ। বাড়ি দেখভালের দায়িত্বে আছেন ইউনুস আলী নামে এক ব্যক্তি। সায়েদুল ইসলাম ঢাকা থেকে মাঝেমধ্যে আসেন গ্রামের বাড়িতে। যন্ত্রের ব্যাপারে ইউনুসের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি।

কৃষি অফিসের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অবসরে যাওয়ার পর তিনটি যন্ত্রের জন্য সায়েদুল ইসলাম নিজে আবেদন করেন। একই অর্থবছরে একজন কৃষক একটি মাত্র যন্ত্র নিতে পারেন, সেখানে সচিব প্রকৃত কৃষক না হয়েও তিনটি যন্ত্র নিয়েছেন, যা সরকারি বিধির মধ্যে পড়ে না। সচিবের চাপে পড়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও ইউএনও স্থানীয়ভাবে ভর্তুকি দরে যন্ত্রের অনুমোদন দিতে বাধ্য হয়েছেন। সরকারের ভর্তুকির আওতায় তিনটি যন্ত্র নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন সায়েদুল ইসলামও। তবে এ বিষয়ে কৃষি বিভাগের কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি।

জানতে চাইলে সে সময়ের কুষ্টিয়া সদরের ইউএনও সাধন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘কৃষকরা যন্ত্রের জন্য আবেদন করলে আমাদের কাজ ছিল রেজুলেশন করে ঢাকায় পাঠানো। সচিব স্যার আবেদন করলে তাঁর নামও আমরা পাঠিয়েছিলাম। যন্ত্র অনুমোদনের এখতিয়ার ঢাকার খামারবাড়ির।’ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি রফিকুল আলম টুকু বলেন, ‘একজন সচিব পিআরএলে যাওয়ার পরও বেতন-ভাতাসহ সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকেন। সরকার প্রান্তিক কৃষকদের যে সুবিধা দিচ্ছে, সেটা খোদ কৃষি সচিব নিলে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। আর একসঙ্গে তিনটি যন্ত্র নেওয়া নিয়মের বড় ব্যত্যয়। এতে রাষ্ট্রের টাকা অপচয় হয়েছে বলে আমি মনে করি।’

কৃষি বিভাগ দুই ভাগনের মুঠোবন্দি

সায়েদুল ইসলাম কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন এক বছর। ২০২২ সালের শেষ দিনে তিনি অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে যান। সায়েদুল যতদিন সচিবের চেয়ারে ছিলেন, কুষ্টিয়া কৃষি বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ছিল দুই ভাগনে– ইলিয়াছ খান খসরু ও নওশের আলী সজীবের কবজায়। দুই ভাগনে কৃষকের তালিকা করতেন নিজেদের মতো করে। তাদের কথা মেনে নিয়ে কৃষি বিভাগকে এক বছরে এলাকায় প্রচুর কৃষিযন্ত্র দিতে হয়েছে। ২০২২ সালে কুমারখালীতে যত সিডার ও পটেটো ডিগার যন্ত্র কৃষক পেয়েছেন, তা সরবরাহ করা হয়েছে দুই ভাগনের তালিকা ধরেই।

খসরু ও সজীবের ভয়ে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মুখে কুলুপ আঁটেন। পীড়াপীড়ির পর কৃষি বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সচিবের দুই ভাগনের অত্যাচারে একটি বছর অফিস করা কঠিন ছিল। অফিসের গাড়ি পর্যন্ত তারা দিনের পর দিন ব্যবহার করেছেন। যন্ত্রের তালিকা করে এনে জোর করে অনুমোদন নিয়ে গেছেন। তারা ঢাকায় যোগাযোগ করে নিজেদের মতো করে বরাদ্দ এনেছেন। কৃষি বিভাগের যাচাই করারও সুযোগ ছিল না। দুই ভাগনে মিলে কুমারখালী তো বটেই, পুরো কুষ্টিয়ায় দালালদের মাধ্যমে যন্ত্র সরবরাহ করেছেন। নিজেদের আত্মীয়স্বজনের নামে বরাদ্দ দিয়েছেন।’

তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, চাঁদপুর ও পান্টি ইউনিয়নে ৪০টির বেশি যন্ত্র বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাগুলাট ইউনিয়নের বাঁশগ্রামে একইভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কৃষিযন্ত্র। কোম্পানির লোকজনের সঙ্গে ছিল তাদের সখ্য। এসব যন্ত্র সরবরাহ করে কোম্পানির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়েছেন তারা। কুষ্টিয়ার বড় বাজারের জনতা ও মুন মেশিনারিজ থেকে সিডার সরবরাহ করা হয় কয়েকটি জেলায়। একইভাবে চুয়াডাঙ্গার সরজগঞ্জ এলাকার জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং কুষ্টিয়ায় অনেক যন্ত্র সরবরাহ করেছে।

এ ব্যাপারে কুষ্টিয়ার জনতা মেশিনারিজের স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেম বলেন, ‘ওই সময় সচিবের ভাগনে পরিচয় দিয়ে সিডার কিনতে কয়েকজন এসেছিলেন। পরে পাশের দোকান থেকে তারা সিডার কিনেছেন বলে জেনেছি।’ পরে পাঁচটি সিডার পাশের মুন মেশিনারিজ থেকে নিয়েছেন বলে প্রতিষ্ঠানটি নিশ্চিত করেছে। মুন মেশিনারিজের ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম শফিক বলেন, ‘কুমারখালীসহ পুরো কুষ্টিয়ায় আমরা ৪০টির মতো সিডার দিয়েছি। সচিবের ভাগনেরাও আমাদের কাছ থেকে সিডার নিয়েছেন।’

কুমারখালীর সব যন্ত্রে ভাগনেদের চোখ

২০২২-২৩ অর্থবছরে কুমারখালীর ১১ ইউনিয়নে ১১৬ কৃষিযন্ত্রের অনুমোদন দেওয়া হয়। চাঁদপুর ইউনিয়নের কৃষকরা পান ৩৫টি যন্ত্র। এর মধ্যে রয়েছে সাতটি সিডার, পাঁচটি রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, চারটি রিপার, আটটি বেড প্লান্টার, চারটি পটেটো ডিগার, তিনটি পাওয়ার থ্রেয়ার, দুটি কম্বাইন হারভেস্টার ও দুটি মেইজ সেলার। কুমারখালীতে চার ধরনের কৃষিযন্ত্র বিতরণে বড় অনিয়ম হয়েছে। এগুলো হলো– সিডার, পটেটো ডিগার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ও বেড প্লান্টার। চার যন্ত্রের দুটি করে অংশ রয়েছে। পাওয়ার টিলারের সঙ্গে সংযোজন করে সেগুলো ব্যবহার করতে হয়। প্রতিটি যন্ত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও কৃষকরা শুধু জমি চাষের জন্য পাওয়ার টিলার ব্যবহার করছেন। বাকি অংশ তারা নেননি। কোম্পানি সুযোগ কাজে লাগিয়ে এসব যন্ত্র উত্তোলন দেখিয়ে সরকারি টাকা তুলে নিয়েছে।

চাঁদপুর ইউনিয়নের জঙ্গলী গ্রামে সচিবের বোনের ছেলে খসরুর মাধ্যমে অনেকে যন্ত্র পেয়েছেন। জঙ্গলী গ্রামে যন্ত্র পাওয়া ৩৫ কৃষকের মধ্যে ১৭ জনের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। জিনাত উল্লাহর ছেলে কামাল লস্কর, করম আলী শেখের ছেলে দুলাল হোসেন, রুস্তম আলীর ছেলে সাগর হোসেন, ধলনগরের জমারত আলীর ছেলে দবির উদ্দিন ও বদর উদ্দিনের ছেলে লাল্টু পাঁচটি সিডার নেন একসঙ্গে। ২০২২ সালে একটি সিডারের দাম ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। কৃষককে দিতে হয় ১ লাখ ১০ হাজার টাকা, বাকিটা ভুর্তকি হিসেবে দেয় সরকার।

কামাল লস্কর বলেন, ‘শহরের বড় বাজারের একটি দোকানে সচিবের ভাগনে খসরু আমাদের নিয়ে যান। খসরুই যন্ত্রগুলো পছন্দ করে দেন। সে সময় পাঁচটি সিডার নেওয়া হয়। সত্যি কথা বলতে, সিডারগুলো আমরা কেউ নিইনি। বড় বাজারের মুন ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে সিডার পাঁচটি কুমারখালী কৃষি অফিসে দেখানোর জন্য নেওয়া হয়। পরে সেখানে যন্ত্র বুঝিয়ে দেওয়ার পর বাড়িতে আসার সময় সিডারগুলো মুন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফেরত দিয়ে এসেছি।’

সচিবের আরেক বোনের বাড়ি পান্টি ইউনিয়নের সান্দিয়ারা গ্রামে। সেই বোনের ছেলে সজীব। পান্টি ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের গোলাম নবীর ছেলে মোতালেব হোসেন। তিনি একসঙ্গে সিডার ও পটেটো ডিগার পেয়েছেন। মোতালেব বলেন, ‘সচিবের ভাগনে সজীব আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে যন্ত্রের জন্য আবেদন করতে বলেন। সজীবই সবকিছু করে দিয়েছেন। তাঁর মাধ্যমে এলাকার আরও কয়েকজন যন্ত্র পেয়েছেন।’

কুমারখালীতে ওই অর্থবছরে ১৫টি পটেটো ডিগার বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে ৯টি বাগুলাট, চারটি চাঁদপুর, একটি পান্টি ও অন্যটি জগন্নাথপুর ইউনিয়নে। ১৫টি পটেটো ডিগারের তালিকা কৃষি অফিসে নিয়ে আসেন ভাগনে সজীব ও স্থানীয় দালাল ওবাইদুর রহমান স্বপন (পল্লি পশুচিকিৎসক)। ১৫ কৃষকের ভোটার আইডি কার্ড, মোবাইল নম্বর ও ছবি ব্যবহার করে কাগজে-কলমে যন্ত্র উত্তোলন দেখানো হয়েছে। তবে খোঁজ নিতে চাঁদপুর ও বাগুলাটে কৃষকদের বাড়িতে গেলে একটি পটেটো ডিগারও পাওয়া যায়নি। পাওয়ার টিলারসহ পুরো পটেটো ডিগার হাওয়া হয়ে গেছে। একেকটি পটেটো ডিগারের দাম প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সরকার প্রতিটি যন্ত্রে অর্ধেক টাকা ভর্তুকি দেয়।

এর মধ্যে বাগুলাট ইউনিয়নের বাঁশগ্রামের মেহেদি আলীর ছেলে সাইফুল ইসলাম তাঁর আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতদের নাম দিয়ে যন্ত্র উত্তোলন দেখিয়েছেন। এর মধ্যে আছেন বাঁশগ্রামের শফিউদ্দিন আহমেদের ছেলে মিলন মণ্ডল, মিলন মণ্ডলের ছেলে সোহাগ, তাদের প্রতিবেশী গোলাম নবীর ছেলে মোতালেব হোসেন ও দবির উদ্দিনের ছেলে মতিয়ার রহমান। মিলন মণ্ডল জানান, সাইফুল তাঁর ভাতিজা। সে ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে স্বপনের মাধ্যমে এসব কাজ করেছে। তাকে ৭ হাজার করে টাকা দিয়েছে।

সোহাগ বলেন, ‘আমি যন্ত্র নিতে চেয়েছিলাম। তবে স্বপন বলেছিল, সরকারি মেশিন ভালো হয় না। বাড়ি আনতে আনতে ভেঙে যেতে পারে। তাই আমি নিইনি। আমিও টাকা পেয়েছি।’ তবে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এক ভাই এসব লেনদেন করেছে। আমি কিছু জানি না।’ এ ছাড়া সাইফুল নিজেই দুটি পটেটো ডিগার যন্ত্র নিজের নামে উত্তোলন দেখিয়েছেন। চাঁদপুর ইউনিয়নে দালাল স্বপনের আরেক ভাই আরশাদুল ইসলাম, মহননগর গ্রামের আবুল বিশ্বাসের ছেলে রতন বিশ্বাস, বহালবাড়িয়া গ্রামের আহম্মদ আলীর ছেলে জালাল উদ্দিন ও একই গ্রামের আবদুল আজিজের ছেলে জাকির হোসেন পটেটো ডিগার যন্ত্র নিলেও সেগুলো হাওয়া হয়ে গেছে।

চাঁদপুর ইউনিয়নের জঙ্গলী গ্রামের পাশে অবস্থিত ধলনগর গ্রাম। এ গ্রামে কিছু হিন্দু পরিবারের বাস। তারা ক্ষুদ্র কৃষক। এ গ্রামের নীলকান্ত সরকারের ছেলে জিতেন্দ্রনাথ সরকারের নামে একটি রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্র তোলা হয়েছে। জিতেন্দ্রনাথের বাড়িতে গিয়ে কথা হলে তিনি বলেন, ‘যন্ত্র আমার বাড়িতে আসেনি, কেমন যন্ত্র চোখেও দেখিনি। দালাল স্বপন আমার কাছ থেকে একটি এনআইডি কার্ড ও ছবি নিয়ে যায়। পরে আমাকে কিছু টাকাও দেয়।’

একই পাড়ার হারান চন্দ্র সরকারের ছেলে বিষ্ণুপদ সরকার ও লক্ষ্মীকান্ত মিত্রের মেয়ে আরতী মিত্রের নামে দুটি বেড প্লান্টার যন্ত্র তোলা হলেও তাদের বাড়িতে গিয়ে সেই যন্ত্রের হদিস মেলেনি। তারা বলেন, ‘স্বপন দালাল আমাদের যন্ত্র দেওয়ার কথা বলে কাগজপত্র নিয়েছিল। পরে যন্ত্র পাইনি।’ স্বপনের খোঁজ করতে গিয়ে জানা যায়, তাঁর বাড়ি চাঁদপুর ইউনিয়নের মিরপুর গ্রামে। বাবা আনসার আলী। তাঁর আপন ভাই আবসাদুল আলমের নামে একটি সিডার তুলে তা বিক্রি করে দিয়েছিলেন স্বপন। আবসাদুল বলেন, ‘সিডার কোথায়, তা বলতে পারবে আমার ভাই স্বপন।’ স্বপন বলেন, ‘এক বছরে আমার মাধ্যমে ১৫ থেকে ২০ জনের মতো কৃষক যন্ত্র পেয়েছেন। আমরা কৃষি অফিসের তালিকা ধরে কৃষককে যন্ত্র বুঝিয়ে দিই, তারা পরে কী করে সেটা তাদের বিষয়।’

কুমারখালী কৃষি অফিসের কর্মকর্তা স্বপন কুমার সিংহ। তিনিও স্বপনের সহযোগী। তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়মের নানা অভিযোগ করেছেন কৃষকরা। দুই স্বপন মিলে কোম্পানির সঙ্গে আঁতাত করে টাকা হাতিয়েছেন। স্বপন কুমার সিংহের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম পেয়ে তাঁকে সম্প্রতি কুমারখালী থেকে সদরে বদলি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে স্বপন কুমার সিংহ অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করেন।

কুমারখালী ছাড়াও কুষ্টিয়া সদর, মিরপুর, দৌলতপুর, খোকসা, ভেড়ামারায়ও যন্ত্র বিতরণে নানা ছলচাতুরীর অভিযোগ অনুসন্ধান চালিয়ে সত্যতা পেয়েছে।

কী বলছেন দুই ভাগনে

সচিবের ভাগনে নওশের আলী সজীব বলেন, ‘মামার প্রভাব দেখিয়ে আমি কোনো সুবিধা নিয়েছি, এটা ঠিক না। যারা বলছে, তারা মিথ্যা বলছে। আমি নিজেই একটি সিডারের জন্য আবেদন করেছিলাম, তাও পাইনি। তবে একটি ভুট্টা মাড়াইয়ের যন্ত্র আমার নামে তুলেছি। কোনো অনিয়মের সঙ্গে আমি জড়িত নই।’ আরেক ভাগনে ইলিয়াছ খান খসরু বলেন, ‘কৃষকদের নিয়ে আমার একটি সমিতি আছে। সমিতির কৃষকের জন্য পাঁচটি সিডার নিয়েছি। এ ছাড়া এলাকার দু-একজনকে আমি সহযোগিতা করেছি। এর বাইরে আমি কোনো তালিকা কৃষি অফিসে পাঠাইনি।’

যা বললেন প্রকল্প পরিচালক

প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘সচিব যদি কৃষক হন, অবশ্যই যন্ত্র পেতে পারেন। তিনি পিআরএলে থাকা অবস্থায় যন্ত্র নিয়েছেন। ওই সময়ে যন্ত্র নিলে সেটা অনিয়ম বলে আমি মনে করি না।’ তিনটি যন্ত্র একসঙ্গে নেওয়ার বিধান আছে কিনা– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের ডিপিপিতে স্পষ্ট বলা নেই যে একজন তিনটা যন্ত্র নিতে পারবে না। তবে আমরা নিরুৎসাহিত করি। অল্প টাকায় ছোট ছোট তিনটা যন্ত্র নিলে সমস্যা দেখি না।’

সাবেক সচিবের ভাষ্য

কর্মসংস্থান ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ভাগনেরা কোনো যন্ত্রপাতি নিয়েছে কিনা আমার জানা নেই। বোন-ভাগনেরা যদি কৃষক হয়, যন্ত্র পেতে পারে। দেখতে হবে সেখানে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা। তাদের অনিয়মের বিষয়ে আমার জানা নেই।’ ভর্তুকি দামে একাই তিনটি যন্ত্র নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি অবসরে গেছি। আমার পৈতৃক ২৫ বিঘা জমিতে ধান আবাদ করছি। সবজিও চাষাবাদ করি। আমি নিজে আবেদন করে তিনটি যন্ত্র নিয়েছি। এখানে কোনো অনিয়ম হয়েছে বলে মনে করি না।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
slotgacor
bacan4d rtp
bacan4d
totoslotgacor
slot gacor
TOTO GACOR
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot
xx1toto
bacansport
bacan4d
toto slot
situs toto
slot gacor
Toto Slot
slot maxwin
slot demo