Hot

গতি নেই অর্থনীতিতে, বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে ৪০ শতাংশের কম

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ও বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানো হয় গত বছর জুলাই মাসে। গত মার্চে ব্যাংকের সুদহার বেড়ে সাড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। যা গত জুলাইয়ে ছিল সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিনিয়োগ। বাড়ছে শিল্পের উৎপাদন খরচ। প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে কর্মসংস্থানে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হারও ১০ শতাংশের কাছাকাছি।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে ৪০ শতাংশের কম। এ সময়ে রাজস্ব ঘাটতি তৈরি হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। দুই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৩০ শতাংশের বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ বিলিয়ন ডলারে। ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এগোচ্ছে মন্থর গতিতে। অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সরকারের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকলেও বড় ঘাটতি রয়েছে আর্থিক হিসাবে। গত বছর ডিসেম্বর শেষে আর্থিক হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫৩৯ কোটি ডলার। যদিও ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আর্থিক হিসাবে ১৪ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাস জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৩১ দশমিক ১৭ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।

অর্থবছরের আট মাস বিবেচনায় এটি গত ১০ বছরের মধ্যে এডিপির সর্বনিম্ন বাস্তবায়নের হার। জানা গেছে, চাপ বাড়ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের প্রভাবের সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিকে দীর্ঘায়িত করছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের সংকট। জ্বালানি তেলের বাজারে বিরাজ করছে অস্থিরতা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বৈশ্বিক খাদ্য শৃঙ্খলায় এক ধরনের চাপ বিরাজ করছে। এদিকে বাংলাদেশে খাদ্যসহ সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়ছেই। ব্যাংক ঋণের চড়া সুদহারের কারণে নতুন করে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান থমকে আছে। শিল্পের উৎপাদন খরচও বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট বৈরী আবহাওয়ার নেতিবাচক প্রভাবের কারণে কৃষি খাতের উৎপাদন কমছে। আবার উৎপাদন খরচ বাড়ছে। সব মিলিয়ে ধীরগতিতে এগোচ্ছে সামগ্রিক অর্থনীতি। এমন পরিস্থিতি নতুন আরেকটি বাজেট প্রণয়নের কাজ করছে অর্থ বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

জানা গেছে, সম্প্রতি ব্যাংক ঋণ ও আমানতের ওপর আরোপিত সুদহারের ৬ ও ৯ শতাংশের সীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। এমনকি পূর্বে কম রেটে নেওয়া ঋণও পরিশোধ করতে হচ্ছে বাড়তি সুদের হারে। এ কারণে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সৃষ্টি হয়েছে মন্দা। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স না বাড়ায় দ্রুত কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেই চলেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ায় বেড়েছে উৎপাদন খরচ। বৈরী আবহাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষিতেও। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানেও স্থবিরতা। অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বাজেট বাস্তবায়ন ৪০ শতাংশেরও নিচে। নতুন বাজেট প্রণয়নে করতে হচ্ছে নতুন হিসাবনিকাশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের ব্যাংক থেকে ধার করার পরিমাণ নতুন অর্থবছরেও বাড়বে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত পূরণে বাজেট ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে নতুন বাজেটের আকার কমিয়ে আনছে সরকার।

তবে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা থেকেই যাবে। বিশেষ করে রাজস্ব আয় বাড়াতে এনবিআরের পরিকল্পনার কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায় না। প্রতি বছরই করদাতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয় কিন্তু তা আর কার্যকর হয় না। ফলে কর-জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের মধ্যেই আটকে আছে। যা কমপক্ষে ২০ শতাংশ হওয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক নামে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এমনকি সরকারের নিজস্ব বিভিন্ন সংস্থার জরিপের তথ্য অনুযায়ী আমাদের কর-জিডিপি রেশিও যা হওয়ার কথা বাস্তবে তার অর্ধেক রয়েছে। অথচ এ রেশিও প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ, নেপালে ২১ দশমিক ৫০, পাকিস্তানে ১৪ দশমিক ৮৮ ও শ্রীলঙ্কায় ১২ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

এদিকে ব্যাংক খাতের অস্থিরতা, অনিয়ম-দুর্নীতি অর্থ পাচার রোধ করতে না পারায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। যা আইএমএফের মানদণ্ড অনুযায়ী ২০ বিলিয়নের ওপরে থাকার কথা। আমদানি খাতে কঠোর নীতি অবলম্বন করেও আমদানি ব্যয় কমানো যায়নি। আবার টাকার বিপরীতে ডলারের মান প্রতিদিনই বাড়ছে। করোনা মহামারির সময়েও যে প্রতি ডলারের বিপরীতে ডলারের মান ছিল ৮৫-৮৮ টাকা। তা এখন ১২০ টাকায় নেমেছে। এরপরও ব্যাংক খাতে তীব্র ডলার সংকট বিরাজ করছে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে ভোগ্যপণ্য আমদানির ওপর ডিউটি মওকুফ করা হয়েছে। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম কমেনি। ফলে মূল্যস্ফীতিও কমেনি, বরং বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ এখনো ১০ শতাংশের কাছাকাছি। অন্যদিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে ব্যাপকভাবে ছন্দপতন ঘটেছে। প্রথম প্রান্তিকের চেয়ে দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে অর্ধেকে। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে অনুষ্ঠিত সরকারের আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হারসংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে এসব বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।

ওই বৈঠকে রাজস্ব আদায় বাড়ানো, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং আর্থিক খাতের নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনা দেন অর্থমন্ত্রী। এরপর তিন মাস কেটে গেলেও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। ওই বৈঠকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি) ৩৯ দশমিক ৮২ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে। অর্থাৎ ৬০ শতাংশের বেশি বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সময় রয়েছে মাত্র চার মাস (মার্চ-জুন)। ৬০ শতাংশ মানে ৪ লাখ ২৯ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। চার মাসে এ বিপুল টাকা খরচ করতে গিয়ে অনিয়ম হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, এতে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও সঠিক ব্যয় অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বাজেট বাস্তবায়নের গতি প্রথমদিকে সব সময়ই কম থাকে। অর্থবছরের শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে শতভাগ এডিপি ও বাজেট বাস্তবায়ন দেখানো হয়। এতে বাজেট ব্যয়ের গুণগত মান ঠিক থাকে না বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে দেশের ব্যাংক খাতে বড় সংকট বিরাজ করছে। কেননা সমস্যা জর্জরিত ব্যাংক খাত পুনর্গঠনে আইএমএফের শর্তের বাস্তবায়ন করছে সরকার। যদিও এক্ষেত্রে একীভূতকরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙুল দেখিয়ে যাচ্ছে অনেক ব্যাংকই। অন্যদিকে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক চাপ প্রতিদিনই বাড়ছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button