দুর্ভোগের শহরে স্বস্তির সারথি
রবিবার, বিকেল প্রায় ৫টা। মতিঝিল মেট্রো রেল স্টেশনে যাত্রীর এমন ভিড় যে পা ফেলার জায়গা নেই। টিকিট কাউন্টার থেকে ট্রেনের দিকে যাত্রীদের একটি স্রোত সচল রয়েছে। একের পর এক ট্রেন এসে থামছে, ছেড়ে যাচ্ছে উত্তরার পথে।
শুধু সন্ধ্যা বলেই অফিসফেরত যাত্রীর চাপ তুলনামূলক অনেক বেশি। তবে দিনের অন্য সময়ও যাত্রীর ভিড় দেখা যাচ্ছে এখন। এভাবে দিন দিন যাত্রী বাড়ছে মেট্রো রেলের ট্রেনগুলোর। সকাল আর সন্ধ্যায় কর্মজীবী মানুষের চাপে ভিড় খুব বেশি থাকে।
এ সময় অনেকে ট্রেনে ওঠার সুযোগ পায় না। বাসের তুলনায় মেট্রো রেলে ভাড়া কিছুটা বেশি হলেও যাত্রীদের স্বস্তি রয়েছে বেশ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয় না, সময় ধরে ঠিকমতো পৌঁছা যায় গন্তব্যে। সড়কের ধুলা-ধোঁয়া আর দূষণ থেকেও হাঁপ ছাড়া যায়।
সব মিলিয়ে একসময়ের স্বপ্নের মেট্রো রেল এখন বাস্তবের স্বস্তির সারথি।
মেট্রো রেলের চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। চাহিদা বুঝে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে মেট্রো রেল বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা মাস ট্রানজিট কম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
সব চাওয়া এখনই পূরণ হচ্ছে না
মেট্রো রেলে যাত্রীর চাপে কিছু নতুন চাহিদা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে ট্রেনের সংখ্যা ও কোচ বাড়ানো উল্লেখযোগ্য।
বিশ্ব ইজতেমা ও বইমেলাকে কেন্দ্র করে বিশেষ ট্রেন ও সময় বাড়ানোর বিষয়ও রয়েছে আলোচনায়। শুক্রবার সপ্তাহিক ছুটির দিনের যাত্রীদের নিয়েও রয়েছে পরিকল্পনা। কিন্তু আপাতত এর কোনো কিছুই হচ্ছে না।
ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, ইজতেমা ও বইমেলাকে কেন্দ্র করে বিশেষ ট্রেন আসছে না। মাসব্যাপী বইমেলা উপলক্ষে এখনই সময় বাড়ানো নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আর শুক্রবার যাত্রী পরিবহন বন্ধই থাকছে। কারণ মেট্রো রেলের খুঁটিনাটি অনেক কাজ এখনো চলছে। সেসব কাজ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে সপ্তাহে এক দিন যাত্রী পরিবহন বন্ধ রাখা জরুরি।
বর্তমানে মেট্রো রেলের একটি ট্রেন সেটে লোকোমোটিভসহ মোট ছয়টি কোচ রয়েছে। দুই পাশে দুটি ইঞ্জিনেও যাত্রী পরিবহন করার ব্যবস্থা রয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, সব মিলিয়ে একটি ট্রেনে একসঙ্গে দুই হাজার ৩০৮ জন যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে গড়ে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে প্রায় এক হাজার ৬৫০ জন। সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না, এমন বাস্তবতায় প্রতি ট্রেনে আরো দুটি করে কোচ যুক্ত করার আলোচনা উঠছে।
সূত্র বলছে, প্রচলিত ট্রেনের মতো চাইলেই মেট্রো ট্রেনে নতুন কোচ লাগিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। সেটের বিন্যাসের ওপর ভিত্তি করে নতুন কোচ তৈরি করতে হবে। সেটি তৈরি হবে জাপানে। যদিও ট্রেনে কোচের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে, তবে সেটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। এখনই ট্রেনে অতিরিক্ত কোচ যুক্ত হচ্ছে না।
এদিকে স্টেশন থেকে ট্রেন চালানোর সময় কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে সর্বনিম্ন প্রতি ১০ মিনিট পর পর একটি স্টেশনে ট্রেন পাওয়া যায়। এই ট্রেন ছাড়ার সময়কে কারিগরি ভাষায় হেডওয়ে বলা হয়। আরো এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণের পর হেডওয়ে কমানো হতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্টেশনে ট্রেন আসার সময় কমতে পারে তিন থেকে পাঁচ মিনিট পর্যন্ত।
ডিএমটিসিএলের সচিব মোহাম্মদ আব্দুল রউফ বলেন, সব কিছু নিয়েই কম্পানির ভেতরে আলোচনা চলছে। আপাতত হেডওয়ে কমানো গুরুত্ব পাচ্ছে। এতে ট্রেন চলাচলের সংখ্যা বেড়ে যাবে। যাত্রীদের সুবিধা হবে। আবার মেট্রো রেলের বর্তমান সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
দীর্ঘ পথে যাত্রী বেশি
বর্তমানে উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬টি মেট্রো স্টেশনই চালু রয়েছে। স্টেশনগুলো ঘুরে দেখা গেছে, দীর্ঘ পথে যাত্রীর চাপ তুলনামূলক বেশি। পাশাপাশি স্টেশনে যাত্রীর চলাচল কম। অন্যান্য স্টেশনের তুলনায় উত্তরা, মিরপুর ১০, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার ও মতিঝিল স্টেশনে যাত্রী বেশি।
দুই প্রান্তের স্টেশনে যাত্রী বেশি হওয়ায় মাঝের স্টেশনগুলোতে ট্রেনে ওঠার জন্য যাত্রীদের ধাক্কাধাক্কি করতে হয়। গত মঙ্গলবার দুপুর ১টা ২০ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি ফার্মগেট পৌঁছলে তাতে যাত্রীরা উঠতে পারছিল না। সব যাত্রী গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় অন্য যাত্রীদের বের হতে ও প্রবেশ করতে কষ্ট করতে হচ্ছিল।
মনোয়ার হোসেন নামের এক যাত্রী বলেন, স্টেশনে ১৫ সেকেন্ডের জন্য ট্রেন থামে। এই সময়ের মধ্যে পেছন থেকে এসে নামা কঠিন। তাই গেটের কাছাকাছি দাঁড়াই। এতে নামতে সুবিধা হয়।
আরেক যাত্রী জালাল উদ্দিন ট্রেনে প্রবেশের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, সবাই দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠেলে উঠতে হয়। ব্যস্ত সময়ে ট্রেনে ওঠার সুযোগও পাওয়া যায় না। একটা ট্রেন ছেড়ে দিয়ে উঠতে হয়।
ট্রেনে প্রয়োজনে ‘পুশম্যান’ যুক্ত করা যেতে পারে, এমন ভাবনার কথা জানিয়েছেন ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক। তিনি জানান, বিশ্বের অনেক দেশের মেট্রো রেলে পুশম্যান রয়েছেন, যাঁরা যাত্রীদের ঠেলে কোচের ভেতরে নেওয়ার কাজ করে থাকে। আমরা এখনই এই ধরনের ব্যবস্থা চালু করতে চাই না। তবে যাত্রীদের সচেতনতা জরুরি। কোচের ভেতরে জায়গা খালি না রেখে অন্যদেরও যাতায়াতের সুযোগ করে দেওয়া দরকার।
পুরোদমে গণপরিবহনের সারিতে মেট্রো রেল
ঢাকার মেট্রো রেলের অভিজ্ঞতা ১৩ মাস পূর্ণ করল। শুরুর কয়েক মাস মেট্রো রেলযাত্রা ছিল অনেকটাই শখের। এখন শখের নিক্তি থেকে বাস্তবের পাল্লায় মাপা হবে আধুনিক এই গণপরিবহনকে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পুরোদমে চলছে ট্রেন। প্রচলিত গণপরিবহন বাসের সঙ্গে মেট্রো রেল করছে প্রতিযোগিতা।
প্রথম ধাপে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রো রেল চললেও এর কোনো প্রভাব ছিল না শহরের গণপরিবহনব্যবস্থায়। দ্বিতীয় ধাপে মেট্রো রেল ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম এলাকা মিরপুর, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, পল্টন ও মতিঝিলকে এক রেখায় যুক্ত করেছে। সরাসরি মেট্রো রেলের প্রভাব বোঝা যাচ্ছে এখন।
এর মধ্য দিয়ে ঢাকার মূল গণপরিবহনব্যবস্থায় যুক্ত হলো মেট্রো রেল। প্রথম ধাপের মতো দ্বিতীয় ধাপেও সব স্টেশন একসঙ্গে চালু করা হয়নি। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ৯টি স্টেশনই চালুর পর মতিঝিল অংশে ধাপে ধাপে খুলেছে সাতটি স্টেশন। ধাপে ধাপে বেড়েছে মেট্রো রেল চলার সময়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অবকাঠামো ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, আংশিক পথে চলায় এত দিন অফিস যাত্রীদের জন্য মেট্রো রেল তেমন আকর্ষণীয় ছিল না। মেট্রো রেলের প্রকৃত সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে।
২০২৫ সালে কমলাপুর যাচ্ছে মেট্রো রেল
উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত পথ ২১.২৬ কিলোমিটার। মেট্রো রেলের এই পুরো পথে ১৭টি স্টেশন থাকবে। প্রথম ধাপে চালু করা হয়েছে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশ, এর দৈর্ঘ্য ১১.৭৩ কিলোমিটার। মতিঝিল পর্যন্ত পথ ২০.১০ কিলোমিটার। আগামী বছর ২০২৫ সালের শেষের দিকে কমলাপুর পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এমআরটি লাইন-৬ নির্মাণে মোট ব্যয় হচ্ছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এতে বিদেশি অর্থায়ন ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। আর সরকার দিচ্ছে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
ডিএমটিসিএলের আওতায় ঢাকায় মোট পাঁচটি লাইন নির্মাণ করা হবে। পাঁচ লাইনে মোট রেলপথের দৈর্ঘ্য হবে ১২৯.৯০ কিলোমিটার। এর মধ্যে উড়ালপথ থাকবে ৬৮.৭৩ কিলোমিটার এবং পাতাল রেলপথ হবে ৬১.১৭ কিলোমিটার। ২০৩০ সালের মধ্যে সব মেট্রো রেলের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার।
এক প্রশ্নের জবাবে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, মেট্রো রেলের সক্ষমতার শতভাগ ব্যবহার করা প্রয়োজন, নয় তো এত ভারী বিনিয়োগের সুফল সবাই পাবে না। মেট্রো রেলের প্রভাব নিচের সড়কে না পড়লে বিনিয়োগ আংশিক সফল হবে।