International

বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্যারিসের ৪৫০ বছরের পুরনো বই বাজার 

আসন্ন ২০২৪ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসকে সামনে রেখে ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে’ বইয়ের স্টলগুলো সরিয়ে নেওয়ার জন্য পুলিশের নির্দেশের পর রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এসেছে ফরাসী ইতিহাসের এই অংশটি।

প্যারিসে সেন নদীর তীরে সারি সারি বইয়ের দোকান।

সাড়ে চারশো বছর ধরে সেন নদীর তীরে সারি সারি বইয়ের দোকানে প্রতিনিয়ত বই বিক্রি করছেন প্যারিসের বই বিক্রেতারা। তাদের সবুজ রঙ এর বিশাল বাক্সগুলো বইপ্রেমীদের কাছে একেকটা সদ্য বেক করা বাগেতের চাইতে কম লোভনীয় নয়!

কিন্তু আসন্ন ২০২৪ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসকে সামনে রেখে ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে’ বইয়ের স্টলগুলো সরিয়ে নেওয়ার জন্য পুলিশের নির্দেশের পর রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এসেছে ফরাসী ইতিহাসের এই অংশটি। বর্তমানে বইয়ের স্টলগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন দোকানিরা।

প্রায় দুইশোর মতো বিক্রেতাদের প্রতিনিধিত্ব করেন কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য বুকিনিস্ত-এর প্রধান জেহোম কালে। তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে ফরাসি আমলাতন্ত্রের প্রবর্তিত প্রিফেকচারাল পুলিশ কর্তৃপক্ষ।  

যদিও প্যারিসের মেয়র বইয়ের স্টলগুলো সরিয়ে নেওয়ার এবং এর খরচ বহন করার এবং সেইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত স্টলগুলো সংস্কার করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন, কিন্তু জেহোম বলছেন যে, তাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই প্যারিসের এমন একটি ল্যান্ডমার্ক সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা তাদেরকে ভবিষ্যত সম্পর্কে ভীত করে তুলেছে।

কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য বুকিনিস্ত-এর প্রধান জেহোম কালে।

‘যাও, তোমাদের সরিয়ে দেওয়া হলো’- এভাবেই জেহোম তার বই বিক্রেতা কমিউনিটির বিষয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তটি সম্পর্কে তার অনুভূতি ব্যস্ত করেছেন।

জেহোম কালে বলেন, পুলিশ গত মার্চে তার কাছে চিঠিতে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। কিন্তু এরপর আর কোনো সাড়াশব্দ পাননি তিনি। এরপর গত জুলাইয়ে সিটি হল একটি সভা ডাকা হয়। কালাইসের ভাষ্যে, ‘তারা আমাদের বলে যে, অলিম্পিক গেমস যতদিন চলবে ততদিন আপনাদের দোকান বন্ধ রাখতে হবে, এক সপ্তাহ আগে থেকেই।”

তিনি আরও জানান, প্রথম একটা পরিকল্পনা ছিল যে বই বিক্রেতাদের বক্সগুলো যে জায়গায় আছে সেখানেই থাকবে। কিন্তু পুলিশ এসে পরিদর্শন করার পরেই তারা এখানে স্টল বন্ধ রাখার কথা জানায়। অথচ অলিম্পিক গেমস উপলক্ষে এ শহরে লাখ লাখ লোকের আগমন ঘটবে, যাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো স্টলগুলো ঘুরে দেখে বই কিনতে চাইবেন।

জেহোম জানান, তাদেরকে জোরপূর্বক দোকান বন্ধ করানোর পর এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি; অন্তত বিক্রেতাদের জানানো যেত যে তারা আবার কবে দোকান খুলতে পারবে।

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

প্যারিসের এই বিখ্যাত বইয়ের দোকানগুলো নিয়ে আরও একটি পরিকল্পনা করা হয়েছে যে, বক্সগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া।  কিন্তু জেহোমের কাছে এটা আরও খারাপ পরিকল্পনা মনে হয়েছে। তার ভাষ্যে, অনেকগুলো বক্সই এখানে প্রায় ৩০-৪০ বছর ধরে আছে। বেশিরভাগই জং ধরে গেছে এবং এগুলোর লক, ফোল্ড, ছাউনি আর চেইনগুলো নাজুক অবস্থায় রয়েছে।

আবার অলিম্পিকস শেষ হয়ে যাওয়ার পর কী ঘটবে তারও নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না।

নদীর তীরে থাকা বেশিরভাগ বইয়ের বক্সই কয়েক দশক পুরনো।

“অলিম্পিকস শেষ হবার পর কি তারা আমাদের আবারও এই জায়গায় বসতে দেবে?” জানতে চান ৩৫ বছর বয়সী বই বিক্রেতা গিয়োম কাস্ত্রো। সাত বছর যাবত সেন নদীর তীরে বই বিক্রি করছেন তিনি। পো দেজ আঁ সেতুর পাশেই তার বইয়ের স্টল।

৫৩ বছর বয়সী আরেক বিক্রেতা জ্যঁ ফ্রাঁসোয়াজ মেদিওনি গত আট বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। তিনিও মনে করেন, অলিম্পিক গেমস চলাকালীন পুরো সময়টায়ই শহরে আরও অনেক কাজই করার থাকবে, তাই এই বইয়ের বক্সগুলো নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে সবার শেষে।

“আমি শঙ্কিত যে আমরা এক বছরের মধ্যেও এগুলো ফিরে পাবো কিনা, হয়তো আর কোনোদিন নাও পেতে পারি”, বলেন মেদিওনি। কাস্ত্রো এবং মেদিওনি, দুজনেই মনে করেন বক্সগুলো তারা নিজেরাই সংরক্ষণ করলেই ভালো হবে। তাদের কাছে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য নেই বলেও অভিযোগ করেন তারা।

প্যারিসে সেন নদীর তীরে সারি সারি বইয়ের দোকান

কাস্ত্রো বলেন, শুধু যে বক্সগুলো সরিয়ে নেওয়াই ব্যয়বহুল হবে কর্তৃপক্ষের জন্য, তা-ই নয়; সেই সাথে অন্য কোনো জায়গায় বইয়ের বাজার সরিয়ে নিলে তেমন চলবেও না। তিনি বলেন, “বই বিক্রেতাদের বসার জায়গা সেন নদীর তীরেই।”

সমর্থন আদায়

প্যারিসের বইবিক্রেতারা এরই মধ্যে রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করেছেন। ফরাসি রাজনীতিবিদ রাশিদা দাতি এই সিদ্ধান্তকে ‘নির্বোধ, অপমানজনক এবং অন্যায্য’ বলে অভিহিত করেছেন।

তিনি এবং আরেক রাজনীতিবিদ জ্য-পিয়ের লেকক মিলে অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য প্যারিস কাউন্সিলে এ বিষয়টি উত্থাপন করবেন।

বইয়ের বক্সগুলোর ব্যাপারে কি করা হবে জানতে চাইলে প্যারিস সিটি হল সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলে, “আমরা পুলিশ প্রিফেকচারকে নিয়ে একটা সভা ডাকবো এবং সেখানে এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও ফলোআপ করা হবে।”

এদিকে প্যারিসের মেয়রের কার্যালয় থেকে কেউ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button