Science & Tech

বিশ্বরেখা : স্থান ও কাল যেখানে একটি রেখায় মিলেছে

স্থানের তিনটা মাত্রা দেখুন। প্রতিটা প্রতিটার ওপর লম্ব। অর্থাৎ একটা মাত্রা আরেকটা মাত্রার ওপর ৯০ কোণে দাঁড়িয়ে আছে। 
সময় যদি চতুর্থমাত্রা হয়, তাহলে এই মাত্রাটা বাকি তিন মাত্রার সঙ্গে কীভাবে আছে? 

ব্যাপারটা কল্পনা করা কঠিন।

স্থান আর কাল পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ স্থানের কোনো এক রেখার ওপর কোনো বস্তু গতিশীল হলে, সেটা কালের দিকেও গতিশীল। অর্থাৎ ট্রেন যদি স্টেশন থেকে সামনে এগিয়ে চলে, সেটা যেমন x-অক্ষের দিকে সামনে এগিয়ে যায় তেমনি সময়ের দিকেও সামনে এগিয়ে যায়। ধরা যাক, ট্রেনটা রাত আটটাও কমলাপুর স্টেশন থেকে ছাড়ল।

এক সময় সেটা পৌঁছুল জয়দেব স্টেশনে । এখন আপনি হাতের ঘড়িটা দেখুন। সময়ও পাল্টে গেছে। ধরা যাক, টেনটা যখন জয়দেবপুর স্টেশনে তখন রাত নটা বাজে।

সময়ের সঙ্গে ট্রেনটা এক ঘণ্টা সামনে এগিয়ে গেছে। এ ব্যাপারটা সবাই জানে ও বোঝে, এটা নতুন কিছু নয়।

এখন ট্রেনটা রাত আটটায় কমলাপুর স্টেশন থেকে না ছেড়ে যদি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকত, তাহলেও কিন্তু সময় চলত। কারণ ট্রেন চলা ছাড়াও আরও অনেক ঘটনা স্টেশেনে ঘটে। হ্যাঁ, ট্রেন ছাড়লে স্টেশন আর ট্রেনের মধ্যে সময়ের আপেক্ষিকতা তৈরি হতো।

তখন স্টেশনে সময়ের গতি একরকম হতো ট্রেনের ভেতর আরেকরকম হতো। কিন্তু ট্রেন যদি না ছাড়ে, তাহলে স্টেশন আর ট্রেনের গতি একই হবে। 
এ তো গেল দ্বিমাত্রিক লাইনের ওপর চলা কোনো ট্রেনের গতি আর সময়ের হিসাব। কিন্তু ধরা যাক, একটা কণা মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রচণ্ড গতিতে। এর গতিপথটা কেমন?

সেই গতিপথে সময়ের তিনটা মাত্রা আর কালের একটা মাত্রা থাকবে! কিন্তু সেই গতিপথটা কী আঁকতে পারবেন? গতিপথটা যদি সরলরেখার মতো হয়, এর সঙ্গে সময়কে মেলাবেন কী করে?

এই মেলানোর কাজটিই করেছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন বহু আগেই। তিনি সৌরজগতের গ্রহদের গতিপথ ব্যাখ্যার জন্য কাল্পনিক কিছু রেখা কল্পনা করেন। সেগুলোই হলো বিশ্বরেখা। পরে আপেক্ষিকতা আসার পর বিশ্বরেখার ধরন বদলে যায়। বলা ভালো, আইনস্টাইন বিশ্বরেখার ধারণা বদলে দেন। অবশ্য আইনস্টাইনের এই কাজের সঙ্গে তাঁর গুরু হারমান মিনকোভোস্কির চারমাত্রা তত্ত্বের যোগ আছে।

২.
আইনস্টাইন যে বিশ্বরেখার কল্পনা করেছিলেন, তাতে স্থানেরর তিনটি আর সময়ের মাত্রাকে একটি রেখায় রূপান্তরিত করা হয়। অর্থাৎ এটা এমন একটা রেখা স্থানের তিনটি আর সময়ের মাত্রা অর্থাৎ চারটি মাত্রাকে একটি মাত্র রেখা দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এই রেখার প্রতিটা বিন্দু কিন্তু মাত্রাহীন কোনো বিন্দু নয়। এই বিন্দুতে স্থানের চারটি মাত্রা যেমন লুকিয়ে আছে। তেমনি সময়ের একটিমাত্রাও আছে।

সাধারণ রেখার মতো বিশ্বরেখাও সরল বিশ্বরেখা এবং বক্র বিশ্বেরেখা হতে পারে। সাধারণ নিউটনীয়ান বলবিদ্যার বিশ্বরেখা হলো সরলবিশ্বরেখা। এই রেখা সোজাসুজি পথে সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলে। অন্যদিকে বক্র বিশ্বরেখার ধারণা এসেছে বক্র জ্যামিতির ধারণা থেকে। 

আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতায় দেখিয়েছিলেন, মহাকর্ষের সঙ্গে বক্র জ্যামিতির সম্পর্ক আছে। ভারী বস্তুর ভর স্পেসটাইম বা স্থানকালকে বাঁকিয়ে দেয়। বাঁকানো সেই স্থানকালের ভেতর কোনো বস্তুর গতিপথ তাই বাঁকানো হবে। 

এমনিতে আলো সবসময় সোজা পথে চলে। কিন্তু পথই যদি বাঁকানো হয়, তাহলে আলোর কণার গতিপথও বক্র হবে। যেমন বিশাল এক নক্ষত্রের কথা ভাবুন। সেটা তার আশাপাশের স্থানকালের বাঁকিয়ে রেখেছে। এ কারণে এর আশাপাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আলোর গতিপথও তাই বেঁকে যাবে।

সরল বা বক্র—যেমনই হোক, আমরা যে বিশ্বরেখার কথা বললাম—এ দুই ধরনের বিশ্বরেখাগুলো খোলা। মানে এ ধরনের রেখার দুটি খোলা প্রান্ত থাকে। কিন্তু সবসময় বিশ্বরেখা খোলা নাও হতে পারে। কারণ, বস্তুদের চলাচলের গতি লুপের মতোও হতো পারে।

সূর্য তার চারপাশের স্থানকালকে বাঁকিয়ে রেখেছে। ফলে, পৃথিবী আটকে গেছে সেই বক্রতার ভেতর। পৃথিবীর গতিপথটা এমনভাবে বাঁকা যে কক্ষপথ ছেড়ে বাইরে যেতে পারে না পৃথিবী। বার বার তাই একই গতিপথে প্রদক্ষিণ করে। পৃতিবীর কক্ষপথটা একটা উপবৃত্তাকার। ফলে পৃথবী এক বছর পর পর সেই একই বিন্দুতে ফিরে আসে। এখানে পৃথিবীর বিশ্বরেখাটি আবদ্ধ লুপের মতো।

অসীম বিশ্বরেখাও আছে। এই বিশ্বরেখার অবস্থান ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের খুব কাছে। ব্ল্যাকহোল তার চারপাশের স্থানকালকে এতটাই বাঁকিয়ে দেয়, সেখান থেকে আলোও বেরিয়ে আসতে পারেন না। অর্থাৎ এখানে স্থানকাল বেঁকে যায় অসীমভাবে। তেমনি সেখানকার বিশ্বরেখাগুলোও তখন অসীম হয়ে পড়ে। ব্ল্যাকহোলের ঘটনাদিগন্তের ভেতর অসীম হয়ে যায় সময়ের প্রবাহ। অর্থাৎ সেখানকার বিশ্বরেখার রূপরেখাও অসীম।

৩. 
বিশ্বরেখার কাজ আসলে কী? 
বিশ্বরেখা আসলে স্থান আর সময়ের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে। সেই সম্পর্ক বস্তুর গতি, ঘটনা সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক, এমনকী মহাকর্ষের কারণে বস্তুর ত্বরিত হওয়ার ব্যাপারটারও একটা পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেয়। সাধারণ আপেক্ষিতায় স্থানকালের বক্রতার কথা বলা হয়েছে, তারও একটা ভৌত ব্যাখ্যা দেয় বিশ্বরেখার এই ধারণাটি। বিশেষ করে মহাবিশ্বে বিশাল শূন্যতায় সময়ের প্রবাহ কেমন হতে পারে তার ব্যাখ্যা দিতে পারে বিশ্বরেখা। 

শুধু আপেক্ষিকতা বা চিরায়ত বলবিদ্যাতেই নয়। কোয়ন্টাম বলবিদ্যা, এমনকি স্ট্রিং থিওরিতেও বিশ্বরেখার তত্ত্বটি বহাল তবিয়তে রয়েছে।
তবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় অতটা স্পষ্ট নয় বিশ্বরেখা। সাধারণ আপেক্ষিকতায় বিশ্বরেখাকে যেমন বিচ্ছিন্ন একটা রেখা হিসেবে আমরা দেখতে পাই, কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় তেমনটা হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ কোয়ান্টাম মেকানিকস চলে অনিশ্চয়তা নীতির ওপর ভর করে। অনিশ্চয়তা নীতি বলে, কোনো কণার গতিবেগ আর অবস্থান একই সঙ্গে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। বস্তুর অবস্থান নির্ণয় করতে গেলে এর গতিবেগ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, আবার গতিবেগ নিশ্চিতভাবে জানতে গেলে অবস্থান অনিশ্চত হয়ে যাবে। তাই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিশ্বরেখাকে নিরবিচ্ছন্ন কোনো রেখার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না।

চিরায়ত বলবিদ্যায় একটা বস্তুর গতিপথ ব্যাখ্যা করার জন্য একটাই বিশ্বরেখা কল্পনা করা হয়। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় কণাদের কোনো নির্দিষ্ট গতিপথ নেই। বরং বহু সম্ভ্যাব্য পথের সমন্বয়ে একটা সম্ভাব্য মেঘের মতো অঞ্চলে থাকবে, সেখানে অসংখ্য বিচ্ছিন্ন বিশ্বরেখা থাকবে।

এই যে কণাদের গতিপথের অনিশ্চিয়তা, সেটা কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের একটা পথ তৈরি করে দেয়। ধরা, যাক, একটা কংক্রিটের দেয়াল। চিরায়ত বলবিদ্যা অনুযায়ী সাধরণ কণা, যাদের ভেদনক্ষমতা অত বেশি নয়, সে সব কণাদের পক্ষে সম্ভব নয় সেই দেয়াল ভেদ করে ওপারে চলে যাওয়া। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় সেটা সম্ভব।

আগেই বলেছি, এই তত্ত্বে কণাদের নির্দিষ্ট কোনো গতিপথ থাকবে না। থাকবে প্রচুর সম্ভাব্য পথ। অজস্র বিশ্বরেখার মধ্যে কোনো কোনো রেখার অন্যপ্রান্ত চলে যাবে দেয়াল ভেদ করে ওপারে। এই নীতি মেনে যদি অজস্র দেয়াল বরাবর ছুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে কিছু না কিছু কণা তাঁদের বিশ্বরেখা অনুসরণ করে দেয়ালের ওপারে চলে যাবে। 

কোয়ান্টাম বিশ্বরেখাগুলোও কণাদের মতো সুপার পজিশনে থাকতে পারে। অর্থাৎ বিশ্বরেখার একই সঙ্গে একাধিক জায়গায় থাকতে পারে। তাই পুরো বিশ্বরেখাটিও একই সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় থাকার সম্ভাবনা আছে।

স্ট্রিং তত্ত্বেও বিশ্বরেখার অস্তিত্ব আছে। তবে সাধারণ জগতে কণারা স্থানের তিনটিমাত্রা আর সময়ের একটি মাত্রায় থাকে। অর্থাৎ বিশ্বরেখায় যেকোনো বিন্দুতে কণাদের তিনটি স্থানের মাত্রা আছে আর একটা সময়ের মাত্রা আছে। কিন্তু স্ট্রিং তত্ত্বে কণাদের মাত্রা মোট ১১টি। তাই স্ট্রিং বিশ্বরেখার যেকোনো একটা বিন্দুতে কণাদের ১০টি স্থানের মাত্রা আর একটি সময়ের মাত্রা পাওয়া যাবে।

স্ট্রিং তত্ত্বে কণার কেবল কণা নয়। এগুলো খুবই সূক্ষ্ম একমাত্রিক স্ট্রিং বা সুতা দিয়ে তৈরি। স্ট্রিংগুলো স্থানকালের ভেতর কাঁপে। একেকরকম স্ট্রিং কাঁপে একেক  মোডে। তাই এদের ভিন্ন ভিন্ন কণা হিসেবে আমরা দেখতে পাই। স্ট্রিং তত্ত্বের বিশ্বরেখাগুলো তাই কম্পনশীল। ১১ মাত্রায় কম্পনশীল। আর স্ট্রিং তত্ত্বের বিশ্বরেখা সব সময় পরিবর্তনশীল। কারণ রেখাগুলি একই সঙ্গে কাঁছে ১১টি মাত্রায় কাঁপছে এবং স্থানকালের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করছে।

মোটকথা স্থান ছাড়া সময়, আবার সময় ছাড়া স্থানের যে মূল্য নেই। সার্বিকভাবে স্থানকালকে একই সঙ্গে বুঝতে প্রতিটা গতিশীল বস্তুর জন্য, কিংবা প্রতিটা ঘটনার জন্য একটা গতিশীল রেখা কল্পনা করা হয়েছে। সেই রেখা  একইসঙ্গে স্থান ও কালকে ব্যাখ্যা করতে পারে। আর সেটাই হলো বিশ্বরেখা।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
totoslotgacor
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
toto gacor
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor