Hot

মেয়াদের মাঝপথে অকেজো এক লাখ ইভিএম, সরকারের সিদ্ধান্ত চাইবে ইসি

২০১৮ সালে দেড় লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কিনেছিল নির্বাচন কমিশন। এসব যন্ত্রের আয়ু্ষ্কাল হওয়ার কথা ১০ বছর। কিন্তু ৫ বছরের মধ্যে এক লাখের বেশি ইভিএম অকেজো হয়ে পড়েছে। যে প্রকল্পের অধীনে এই যন্ত্রগুলো কেনা হয়েছিল, সে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী জুনে। ইভিএমগুলো রক্ষণাবেক্ষণেও প্রকল্পে কোনো অর্থসংস্থান নেই।

এখন এসব অকেজো ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কী করবে, তা নিয়ে তারা সিদ্ধান্তহীনতায় আছে। এ বিষয়ে নির্দেশনার জন্য সরকারের দ্বারস্থ হচ্ছে সাংবিধানিক এই সংস্থা। নির্দেশনা চেয়ে ঈদের পর সরকারকে চিঠি দেবে তারা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে ইভিএম কিনতে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার ‘ত্রুটিপূর্ণ’ প্রকল্প নিয়েছিল ইসি। যে কারণে এখন এই অবস্থা তৈরি হয়েছে।

২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কেনা এসব ইভিএমের প্রতিটির দাম পড়েছিল প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। তখন ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে এসব যন্ত্র কেনা হয়েছিল। ভোটে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের বিতর্ক থাকলেও কমিশন তখন তা আমলে নেয়নি। কেন, কার স্বার্থে এই ইভিএম কেনা হয়েছিল, তার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রকল্পটি পাস হওয়ার আগে ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের এক সভায় প্রকল্পটির বিষয়ে কয়েকটি সিদ্ধান্ত ছিল। এর মধ্যে ছিল ইভিএমগুলো সংগ্রহ করার পর সেগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ইভিএমের ১০ বছরের ওয়ারেন্টির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি রক্ষণাবেক্ষণ অঙ্গের বিস্তারিত ব্যয় বিভাজন দিতে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি যেভাবে পাস হয়, তাতে ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা খাত ছিল না। একসঙ্গে দেড় লাখ ইভিএম না কিনে পর্যায়ক্রমে কেনার পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু সেটাও মানা হয়নি।

এসব ইভিএম কেনার আগে পর্যালোচনার জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে উপদেষ্টা করে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে ইসি। কমিটি এই ইভিএমে ভোটার ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি (যন্ত্রে ভোট দেওয়ার পর তা একটি কাগজে ছাপা হয়ে বের হবে) যুক্ত করার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ওই সুপারিশও তখন আমলে নেয়নি ইসি।

উপজেলা নির্বাচনে ৯ জেলায় ভোট হবে ইভিএমে

২০১৮ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে ইভিএম কেনার এই প্রকল্প পাস হয়। তড়িঘড়ি করে বিপুল ব্যয়ে এসব যন্ত্র কেনা হলেও ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসনে এই যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন ইসি। তবে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে নতুন প্রকল্প অনুমোদন না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত কোনো আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়নি। ২০১৮ সালের পর বিভিন্ন সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। এবারের উপজেলা নির্বাচনে ৯টি জেলায় ভোটে ইভিএম ব্যবহার করা হবে।

ইভিএম কেনার এই প্রকল্প শুধু ত্রুটিপূর্ণ ছিল তা নয়, এই যন্ত্রগুলোও নিকৃষ্ট মানের। এসব যন্ত্র রক্ষণাবেক্ষণেরও যথাযথ ব্যবস্থা করা হয়নি। অভিযোগ আছে, মূলত বাণিজ্যের জন্য এসব যন্ত্র কেনা হয়েছিল। তিনি এ-ও বলেন, কেন, কার স্বার্থে বিপুল ব্যয়ে এসব ইভিএম কেনা হয়েছিল, তা তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন

সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার

ইসিকে এসব ইভিএম সরবরাহ করেছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড (বিএমটিএফ)। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এই সংস্থা ইসিকে জানিয়েছিল, প্রায় ৪০ হাজার যন্ত্র নষ্ট। বাকি ১ লাখ ১০ হাজার ইভিএমেরও মেরামত প্রয়োজন। এ জন্য লাগবে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় তখন ইসিকে এই টাকা দেয়নি।

ইভিএম প্রকল্পের সূত্র জানায়, এখন দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে অন্তত ১ লাখ ৫ হাজার ইভিএম অকেজো বা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ৩০-৪০ হাজার ইভিএম একেবারেই নষ্ট বা মেরামত অনুপযোগী। মূলত মাঠপর্যায়ে ইভিএমগুলো সংরক্ষণ করা এবং মেরামতের জন্য বরাদ্দ না থাকায় বেশির ভাগ ইভিএম আংশিক নষ্ট হয়ে গেছে।

অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এই প্রকল্প পাস করা হয়নি। ইভিএম কেনার জন্য ২০১৮ সালে নেওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। পরে মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়।

‘প্রকল্পে ত্রুটি ছিল’

নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর গত বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, আগের নির্বাচন কমিশনের উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁরা ইভিএমগুলো পেয়েছেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে ওই সময় যেভাবে প্রকল্পটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তাতে ত্রুটি ছিল। প্রকল্প নেওয়ার আগে পাইলটিং করা হয়নি। এসব যন্ত্র মেরামত, সংরক্ষণ ও ইভিএম পরিচালনায় জনবলের সংস্থান প্রকল্পে ছিল না। এ বিষয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হবে। তবে তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন করে ইভিএম কেনার প্রকল্প নেওয়ার পরিকল্পনা ইসির নেই।

কিন্তু গত সংসদ নির্বাচনের আগেও নতুন করে দুই লাখ ইভিএম কিনতে চেয়েছিল বর্তমান কমিশন। এ জন্য তারা ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছিল পরিকল্পনা কমিশনে। তবে অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এই প্রকল্প পাস করা হয়নি। ইভিএম কেনার জন্য ২০১৮ সালে নেওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। পরে মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়।

প্রকল্পে সংরক্ষণের খাত না থাকায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। এখন ইভিএমগুলো নিয়ে কী করা হবে, তার নির্দেশনা চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে চিঠি লেখা হবে। ঈদের পর এই চিঠি পাঠানো হবে।

নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ

ইসি সূত্র জানায়, আগামী জুনে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এরপর এই ইভিএমগুলোর কী হবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় আছে ইসি। কারণ, বেশির ভাগ ইভিএম অকেজো, এগুলোর মেরামত করতে হলে বড় অঙ্কের টাকা প্রয়োজন। মেরামত করার পর আবার এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য টাকা ও জনবল লাগবে। ইতিমধ্যে এগুলো রাখার জন্য ভাড়াবাবদ ৫০ কোটি টাকার বেশি বকেয়া জমেছে। তবে এসব মেরামতের জন্য আর সরাসরি টাকা চাইবে না ইসি। তারা পরিস্থিতি তুলে ধরে সরকারকে চিঠি দেবে। এ ক্ষেত্রে ইসির হাতে আরেকটি বিকল্প হলো, এই যন্ত্রগুলো ধ্বংস (ডিসপোজ) করে ফেলা।

নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, প্রকল্পে সংরক্ষণের খাত না থাকায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। এখন ইভিএমগুলো নিয়ে কী করা হবে, তার নির্দেশনা চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে চিঠি লেখা হবে। ঈদের পর এই চিঠি পাঠানো হবে। তবে যে ইভিএমগুলো সচল, সেগুলো যত দিন ব্যবহার করা যায়, তা ব্যবহার করা হবে। এ জন্য যা যা করা দরকার, তার ব্যবস্থা করা হবে।

২০১০ সালে দেশে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএমের ব্যবহার শুরু হয়। এর প্রসার শুরু হয় ২০১৮ সালে। শুরু থেকেই এই যন্ত্রের ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক আছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটসঙ্গী কয়েকটি দল ইভিএমে ভোট করার পক্ষে। অন্যদিকে বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বেশির ভাগ দলের মধ্যে ইভিএম নিয়ে সন্দেহ, অবিশ্বাস কাজ করছে। আবার ভোটারদের অনেকেই এই যন্ত্রে ভোট দিতে এখনো স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। অনেক ভোটারের প্রযুক্তিভীতি আছে-এটি ইসিও স্বীকার করে নিয়েছে। এর বাইরে ইভিএমে ভোট দিতে গেলে আঙুলের ছাপ না মেলা, কারিগরি ত্রুটির কারণে ভোট গ্রহণে দেরি হওয়ার মতো বিড়ম্বনাও রয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ইভিএম কেনার এই প্রকল্প শুধু ত্রুটিপূর্ণ ছিল তা নয়, এই যন্ত্রগুলোও নিকৃষ্ট মানের। এসব যন্ত্র রক্ষণাবেক্ষণেরও যথাযথ ব্যবস্থা করা হয়নি। অভিযোগ আছে, মূলত বাণিজ্যের জন্য এসব যন্ত্র কেনা হয়েছিল। তিনি এ-ও বলেন, কেন, কার স্বার্থে বিপুল ব্যয়ে এসব ইভিএম কেনা হয়েছিল, তা তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button