১১ বছরে শিল্প ও কর্মসংস্থান বেড়েছে সামান্যই
জুলাই আন্দোলনে পতিত হাসিনা সরকার দেশের অর্থনীতিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় দেখালেও বাস্তবে সেটা হয়নি। দেশে ২০১৩ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত উৎপাদনমুখী শিল্প বেড়েছে মাত্র এক লাখ ৩৮ হাজার বা ১৫ শতাংশ। কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ৬২ লাখ মানুষের। অথচ আগের ১০ বছরে উৎপাদনমুখী শিল্প বেড়েছিল চার লাখ ৫২ হাজার, আর কর্মসংস্থান হয়েছিল এক কোটি ৩৩ লাখ মানুষের।
গতকাল বুধবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ‘অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পরিসংখ্যান ভবনে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন অর্থনৈতিকসংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভাপতি ড. কে এস মুর্শিদ। এটি ছিল সরকারের চতুর্থ অর্থনৈতিক শুমারি।
এর আগের ২০১৩ সালে তৃতীয় এবং ২০০৩ সালে দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শুমারি করা হয়।
অর্থনেতিক শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ১১ বছরে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে অর্থনৈতিক ইউনিটের (প্রতিষ্ঠান) সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ১৫.৩৯ শতাংশ। অথচ ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সময়ে পরিচালিত শুমারির তুলনায় ২০১৩ সালের শুমারিতে এ খাতে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা বেড়েছিল ১০০.৪২ শতাংশ। ২০২৪ সালে দেশে মোট অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪ টিতে, যা ২০১৩ সালে ছিল ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫টি।
এই হিসাবে ১১ বছরে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ৪০ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯৯টি বা ৫১.৯১ শতাংশ বেড়েছে। এর আগের জরিপে দেশে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ৪১ লাখ ১০ হাজার ৪২১টি বেড়েছিল, যা ২০০৩ সালের ৩৭ লাখ আট হাজার ১৪৪টি ইউনিটের তুলনায় ১১০.৮৫ শতাংশ বেশি।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের প্রতিষ্ঠানে তুলনামূলক কম প্রবৃদ্ধি হওয়ায় অর্থনৈতিক ইউনিটে এ খাতের অবদান ৮.৭৭ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০৩ সালে মোট অর্থনৈতিক ইউনিটে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অংশ ছিল ১২.১৪ শতাংশ, যা ২০১৩ সালে ১১.৫৪ শতাংশে নেমে আসে। এ হিসাবে টানা দুই শুমারিতেই কমছে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের প্রতিষ্ঠানের অংশ।
গত ১১ বছরে সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৯ লাখ ১৫ হাজার ৯৮২ থেকে ৫৬.৬৮ শতাংশ বেড়ে এক কোটি আট লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৬ টিতে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। এর ফলে মোট প্রতিষ্ঠানে সেবা খাতের অংশ ৮৮.৮৬ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১.২৩ শতাংশে।
গেল এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার বেড়েছে ৪০ লাখ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে ৪০ লাখ ৫৮ হাজার খানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। অথচ এর মধ্যে উৎপাদন খাতের প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে মাত্র এক লাখ ৩৮ হাজার। গত ১০ বছরে মাত্র ৬২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, অর্থনৈতিক ইউনিটের বৃদ্ধি শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি হারে বেড়েছে। দেশের মোট অর্থনৈতিক ইউনিটের মধ্যে শহরে রয়েছে ৫৫ লাখ ৩১ হাজার ২০৩টি। অন্যদিকে গ্রামে ইউনিটের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৩ লাখ ৪৬ হাজার ১৬১টি। ৯৩.৫৩ শতাংশ ইউনিট পরিচালিত হয় পুরুষ দ্বারা। নারী পরিচালক রয়েছেন সাত লাখ ৬৮ হাজার ৪২টি ইউনিটে। দেশের অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোতে কাজ করছে তিন কোটি সাত লাখ ৬১ হাজার ৩৪ জন। যার মধ্যে ৫৬.৮২ শতাংশ গ্রামীণ।
অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘গ্রাম ও শহরে উদ্যোক্তার অভাব নেই। এত উদ্যোক্তা যে চারদিকে দেখি উদ্যোক্তা। মনে হয় বাংলাদেশ উদ্যোক্তাদের দেশ। কিন্তু উদ্যোক্তাদের মূলধন নেই। দেশের উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন করলে অনেক কর্মসংস্থান হবে। এদের ঋণ ও টাকা দেওয়া হয় না। অথচ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লুট হয়েছে। ব্যাংকও খালি হয়ে গেছে। ব্যাংক থেকে এসব টাকা চলে গেছে।’
কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘রাতারাতি ধনী হওয়া কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। নামকরা এসব প্রতিষ্ঠানের শুধু ঋণ আর ঋণ, বাস্তবে কিছুই নেই। সরকার নিজের টাকা খরচ করে এসব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতন দিচ্ছে। রাতারাতি ধনী হওয়া প্রতিষ্ঠানের অনেক শ্রমিককে আমরা আন্দোলন করতে দেখছি।’
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘বিদায়ি সরকারের আমলে শিক্ষকদের গ্র্যাচুইটির ছয় হাজার কোটি টাকা দুর্বল ব্যাংকে রেখে লোপাট করা হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রভাবশালীরা নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ পেলেও সাধারণ উদ্যোক্তারা পাননি।’ এটি অর্থনৈতিক বৈষম্যের বড় উদাহরণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রকল্পটির পরিচালক এস এম শাকিল আখতার বক্তব্য দেন।