ঋণ নির্ভরতায় খাদের কিনারে অর্থনীতি
সরকার ঋণনির্ভর উন্নয়ন বাস্তবায়ন করছে। দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে নীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে। বর্তমানে নীতিমালা প্রণয়নের মাঝে দুর্নীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। ঋণনির্ভর অর্থনীতি দেশকে খাদের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। ব্যাংকিং খাতে নীতি তৈরি করা হচ্ছে নির্দিষ্ট কোনো দুর্নীতি করার জন্য। দুর্নীতি এখন আমাদের সিস্টেমে (ব্যবস্থাপায়) যুক্ত হয়ে গিয়েছে।
গতকাল রাজধানীর মহাখালী ব্র্যাক সেন্টারে দ্য ঢাকা ফোরাম আয়োজিত ‘রিজিওনাল অর্থনীতি-এখন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে এসব বলেন অর্থনৈতিক বিশ্লষকরা। তাদের মতে, সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাবে দেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সন্দিহান। দেশে যদি চেইন ইন ব্যালেন্সিং কাউন্টার বেইলিং ফ্যাক্টর না থাকে তাহলে দেশের রাজনীতি অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। একইসঙ্গে শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাবে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটছে না বলেও জানান তারা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দুর্নীতির মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এখন ব্যাংকিং খাতে নিয়মনীতি তৈরি হচ্ছে দুর্নীতির প্রয়োজনে। গত ১৫ বছরে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্কটা কেমন হয়েছে তার একটি বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন।
আমরা শুনে থাকি উন্নয়ন হয়েছে, দুর্নীতি হয়েছে। এমন কথাও প্রচলন আছে মাঠে যে, উন্নয়ন হলে দুর্নীতি কিছুটা হবে। কিন্তু দুর্নীতি এখন আমাদের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হয়ে গেছে। দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার আরেক কারণ হচ্ছে জবাবদিহিতা না থাকা। সরকার ও প্রশাসনে জবাবদিহিমূলক আচরণ অনুপস্থিত হওয়ার কারণ হচ্ছে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা মন্তব্য করে তিনি বলেন, শুধু ৭ই জানুয়ারির নির্বাচন নয়, অতীতের ধারাবাহিকতায় দেখেছি নির্বাচনী ভোটটা অনুপস্থিত হয়ে গেছে। যশোরের হাইটেক পার্ক এখন কমিউনিটি সেন্টারের জন্য ভাড়া দিতে হচ্ছে মন্তব্য করে জিল্লুর রহমান বলেন, গত ১৫ বছরে উন্নয়নের অর্থায়নটা ঋণনির্ভর হয়ে গেছে। উন্নয়ন খরচের অদক্ষতা অনেক বেড়ে গেছে। একদিকে ঋণনির্ভর উন্নয়ন আমাদের ব্যবস্থাপনায় একীভূত হয়ে গেছে। আর অদক্ষতা ও জবাবদিহিতায় ধস নেমেছে, দুর্নীতি করাটা আমাদের সিস্টেমে (ব্যবস্থাপনায়) যুক্ত হয়ে গেছে। তৃতীয়ত ব্যাংকিং খাতে নিয়মনীতি তৈরি হচ্ছে দুর্নীতির প্রয়োজনে। নীতি তৈরি করা হচ্ছে নির্দিষ্ট কোনো দুর্নীতি করতে। এভাবে দুর্নীতি করা হচ্ছে। সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতি করছে, ধরা পড়লেও তাদের বিচার হচ্ছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, আপনি দুর্নীতি করছেন সমস্যা নেই। বলা হচ্ছে, আর করিস না। এভাবে দুর্নীতি আমাদের সিস্টেমে একীভূত হয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচেছ। এগুলো অদক্ষ অর্থনীতির কু-শাসন। এর পরিণতি সম্পর্কে তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের শূন্যতা তৈরির আভাস দেখতে পাচ্ছি। আর্থিক হিসাবে কিন্তু ঘাটতি এখনো আছে। কর্মসংস্থানের জন্য শিক্ষিত যুবকরা দেশ ছাড়ছে। এতে ব্রেন ড্রেন (মেধা পাচার) হচ্ছে। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার সময়ে এটি কাক্সিক্ষত না।
অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, আমাদের রাজনৈতিক অধিকারগুলো এক এক করে নিয়ে যাচ্ছে। সরকার আইয়ুব খানের নীতিতে চলছে। আইয়ুব খান বলেছিল, উন্নয়নকে এগিয়ে দেই-গণতন্ত্রকে একটু ধীর করে দেই। তিনি বলেন, এখন সরকার বলছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে রাজনৈতিক অধিকারের প্রয়োজন থাকবে না। এজন্য সরকার অবকাঠামোগত দিকেই যাচ্ছে। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও অনেক দেশ করেছিল। এজন্য সরকার বলছে, দেশ সিঙ্গাপুর হবে, তা তো হয়নি। গত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর এখন দেশ ফ্রাঙ্কাইন স্টাইলের যাচ্ছে। দেশে এখন অর্থনৈতিক সংকট চলছে। রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত অর্থনীতির ক্ষয় চলবে।
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ চলছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতি হচ্ছে। গত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে অনেক ধরনের ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আওয়ামী লীগ নিজ দলের আদর্শে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এসব ঘটনার বাইরেও বড় একটি ঘটনা ঘটেছে, তা হলো ক্ষমতায় বহিঃশক্তির ব্যবহার বেড়েছে। বিশেষ করে রাজনীতিতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করি। বাংলাদেশের সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে অভাবনীয় ক্ষমতা দিয়েছে। এক ব্যক্তির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। দলের মধ্যেও গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকায় এক ব্যক্তি দলে দীর্ঘদিন প্রধান থাকছেন, তিনিই প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অর্থনীতি একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে তা সাধারণ মানুষও বুঝে। প্রথমত, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের দায়-দেনা বড় আকারে যুক্ত হয়েছে অর্থনীতিতে। বৈদেশিক ঋণ সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও বাড়ছে। এটি বিনিময় হারের উপর চাপ তৈরি করছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমিয়ে দিচ্ছে। তিনি বলেন, দ্বিতীয় হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির ধারা শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সরকারি বিনিয়োগের উপর। যেভাবে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে, আয় বৈষম্য বাড়ছে তাতে কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়ছে। এর কারণ হিসেবে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যে রাজনৈতিক জবাবদিহিতার মধ্যে উন্নয়ন রাষ্ট্র পরিচালনার কাজটি হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে সবখানে। তারা এক ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপানয় কু-প্রভাব বিস্তার করছে। তাদের মোকাবিলা করার জন্য যে রাজনৈতিক শক্তি করার তা দেখা যাচ্ছে না কোথাও। সরকারেও তা হচ্ছে না। এর সমাধানে শুধু সমালোচনা করলেই হবে না মন্তব্য করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের দুর্ভাগ্য হলো একটি গণতন্ত্রহীনতা ও কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে বের হতে কী উপায় আছে তা বিরোধী রাজনৈতিক দল বলছে না। আমরা একদিকে একটা গণতন্ত্রহীনতার ভিতরে তথাকথিত উন্নয়নের মধ্যে রয়েছি। অন্যদিকে এর কার্যকর বিকল্প হিসেবে আমাদেরকে আস্থায় নিতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন দেশে একজনই সব। মানে তারাই সিদ্ধান্ত নেবে তারাই সব করবে। এটা হওয়ার কারণে কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতি অর্থনীতির অবস্থা এই হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের অর্থনীতির পলিসিগুলোর কোনো সমন্বয় নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে যারা সবকিছু করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন রাজনৈতিক মতের ব্যক্তিরা শিক্ষক হতে আবেদন করার সাহস পাচ্ছে না। গত ১৫ বছরে ৯০০ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে সরকারি মতাদর্শের। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কেমন তা সহজেই বোঝা যায়। সরকার নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নির্যাতনের মাধ্যমে বিরোধী দলকে নির্বাচন থেকে বিরত রেখেছে।