Bangladesh

কিশোর গ্যাংয়ে বাড়ছে অপরাধ

► হঠাৎ অপরাধ বাড়ার মূলে উঠতি যুবারা ► নতুন তালিকা ধরে বিশেষ অভিযান

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে হঠাৎ করে অপরাধ বেড়েছে। পুলিশের মূল্যায়ন হচ্ছে—এর মূলে রয়েছে কিশোর-তরুণ গ্যাং। হত্যা, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখল থেকে শুরু করে এসব অপরাধী সুযোগ পেলেই নারীদেরও উত্ত্যক্ত করছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের যেকোনো স্পটে এ ধরনের সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটলেই তাদের নামটা শুরুতেই উচ্চারিত হচ্ছে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে নতুন করে কয়েক হাজার কিশোর-তরুণ অপরাধীর তালিকা বানিয়ে পুলিশ এরই মধ্যে তাদের গ্রেপ্তারে অভিযানেও নেমেছে। পুলিশের একাধিক প্রতিবেদনে কিশোর-তরুণ অপরাধীদের ব্যাপারে এ ধরনের নেতিবাচক তথ্য উঠে এসেছে।

বিগত সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিলের আগে রাজধানীতে অন্তত ১২৭টি কিশোর গ্যাং গ্রুপ সক্রিয় ছিল। সারা দেশে ছিল ২৩৭টি।

এসব গ্যাংয়ের সদস্য ছিল দুই হাজারের বেশি। প্রতিটি থানায় তাদের তালিকা ছিল। পুলিশের দাবি মতে, গত ৫ আগস্টের আগে ও পরে দেশের বেশির ভাগ থানা নাশকতায় ধ্বংস হওয়ায় সেই তালিকাও ধ্বংস হয়ে গেছে। সংগত কারণে এখন নতুন করে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা তৈরি করা লাগছে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি কিশোর অপরাধের মাত্রা যেভাবে বাড়ছে, তা নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রয়োজনে কিশোর কারাগার ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। কিশোর সংশোধন কেন্দ্রগুলোকে আরো সময়োপযোগী করে সংশোধন কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষম করে গড়ে তোলা যেতে পারে। তবে এই কিশোর গ্যাং নির্মূলে পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

কিশোর-তরুণ গ্যাং ফের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে ওঠায় নতুন তালিকা ধরে পুলিশের সব ইউনিটপ্রধানকে এরই মধ্যে নির্দেশ দিয়েছেন মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে তিন মাসে ১০ জন খুন হয়েছেন। এসব হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগ ঘটনায় কিশোর-তরুণ অপরাধীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হাফিজুর রহমান বলেন, কয়েক দিনেই যৌথ বাহিনীর অভিযানে দেড় শতাধিক অপরাধী ধরা পড়েছে, যাদের বেশির ভাগের বয়স ১৫ থেকে ২১ বছরের মধ্যে।

এদিকে গত ২৮ অক্টোবর চাঁদপুর শহরে অস্ত্র নিয়ে কিশোর গ্যাং মহড়া দেয় এবং তারা দুজনকে কুপিয়ে জখম করে। পরে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে পুলিশ অভিযান চালিয়ে আট কিশোরকে আটক করে।

এর আগে ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় চাঁদপুরের ছায়াবাণী এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হয় ঢালীরঘাট এলাকার স্কুলছাত্র রাশেদ (১৫)। তার আগে ২৬ অক্টোবর রাতে শহরের পুরানবাজার জাফরাবাদে ওয়াজ শুনতে গিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গুরুতর আহত হয় আল-আমিন একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সিফাত পাটোয়ারী।

চট্টগ্রামেও কিশোর-তরুণ গ্যাং সদস্যদের বাড়াবাড়িও আলোচনায় এসেছে। পুলিশ বলছে, চট্টগ্রামে আগের সরকারের আমলে ৫৭টি কিশোর-তরুণ গ্যাং ছিল। রাজশাহী, যশোর, বরিশালসহ আরো কয়েকটি জেলা ও থানা শহরে এই গ্যাংয়ের তৎপরতা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর দেশজুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ, র‌্যাবসহ জেলা প্রশাসনও একাধিক বৈঠক করেছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র বলছে, সরকার পরিবর্তনের পর আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি ঘটে। বিশেষত রাজধানীর মোহাম্মদপুরে প্রতিনিয়ত ছিনতাই, ডাকাতি, চুরি ও হত্যাকাণ্ড বাড়ছে। বিহারি ক্যাম্প ঘিরে মাদক কারবারিরা আধিপত্য বিস্তারে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটিয়েছে। একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা দাবি করেছেন, মোহাম্মদপুরে ২০টি গ্রুপে এক হাজারের বেশি কিশোর-তরুণ সদস্য রয়েছে।

সূত্র মতে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এলাকায় ১৫০টি স্থায়ী ও মোবাইল চেকপোস্টের পাশাপাশি ৩০০টি মোটরসাইকেল টিম এবং ২৫০টি টহল টিম সক্রিয় রয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৫টি প্রাণ ঝরে। এর মধ্যে একাধিক আলোচিত হত্যাকাণ্ডও ছিল। সূত্র মতে, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য শুরু হওয়ার প্রথম দিকে ২০১৫ সালের ২৭ মে উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে অনিক নামের এক কিশোর খুন হয়। এর পরে ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের ঘরোয়া দ্বন্দ্বে খুন হয় নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির। মূলত আদনান খুন হওয়ার পর উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশত কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পায় পুলিশ ও র‌্যাব।

অপরাধ বিশ্লেষক নুর খান বলেন, কিশোর-তরুণ অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সমাজে অপরাধ বাড়বে। আগেও কিশোর অপরাধীরা বেপরোয়া ছিল, সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ছিল। এখন আবার তাদের তৎপরতা চোখে লাগছে। বাড়াচ্ছে উদ্বেগও।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button