Bangladesh

মাদকে সয়লাব দেশ

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর স্থবিরতায় সারা দেশ মাদকে সয়লাব। গত চার বছরে দেশে অন্তত ৪০ লাখ মাদকসেবী বেড়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা এক কোটির বেশি। একটি পক্ষের ধারণা ই-সিগারেটের মাধ্যমেও মাদকসেবী বাড়ছে।

মাদকসেবীদের বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী। দেশের ৩০ শতাংশ যুবকের মধ্যে বেশির ভাগই মাদকে জড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে দেশের বহু পরিবারে চলছে অশান্তি। এরই মধ্যে দেশের কয়েকটি জায়গায় মাদকাসক্ত সন্তানের অত্যাচার সাইতে না পেরে বাধ্য হয়ে মা-বাবা তাদের সন্তানকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন।

এমনকি সন্তানকে খুন পর্যন্ত করতে বাধ্য হয়েছেন এক বাবা। মাদক সহজলভ্য হওয়ায় স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নতুন শিক্ষার্থী জড়াচ্ছে মাদকে। এই ভয়াবহ অবস্থা নিরসনে সরকারের কাছে মাদক সংস্কার কমিশন গঠনের দাবি উঠছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, মাদক বিশেষজ্ঞ, পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এই অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতার  চিত্র পাওয়া গেছে।

হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক : বাংলাদেশে মায়ানমার থেকে ইয়াবা আর ভারত থেকে আসা ফেনসিডিলের বাজার বহু আগে থেকে। এর সঙ্গে নতুন নতুন মাদকও যুক্ত হচ্ছে, যা রোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশব্যাপী থানাগুলো জনতার রোষানলের শিকার হয়। এর পর থেকে বেশ কিছুদিন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতি মাদক কারবার অনেকটাই নির্বিঘ্ন করে এবং সারা দেশে সহজলভ্য হয় মাদক।

https://0f45abeedbb2fd35ddd2d0f9094970ab.safeframe.googlesyndication.com/safeframe/1-0-40/html/container.html এখন হাত বাড়ালেই মিলছে নানা ধরনের  মাদক। এই অবস্থায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কঠোর অবস্থানের কথা জানানো হলেও মাঠে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।

শনিবার দুপুরে রাজধানীর জুরাইনের নতুন রেললাইনের ওপর বসে থাকতে দেখা যায় ২৫-২৬ বছরের এক যুবককে। তাঁর কাছে আসেন আরেক যুবক। আগে থেকে বসে থাকা যুবক জানতে চান, ‘কিরে বাবা আনছস?’ সঙ্গে সঙ্গে ওই যুবক একটি প্যাকেট থেকে তিনটি ইয়াবা তুলে দেন বসে থাকা যুবকের হাতে। বসে থাকা যুবক বলতে থাকেন—‘বুঝলি, এখন আর একটায় হয় না। বেশি বেশি লাগে।’ বলেই মাদক নিয়ে আসা যুবকের দিকে এক হাজার টাকার নোট বাড়িয়ে দেন। বিক্রেতা যুবক ১০০ টাকার একটি নোট ফিরিয়ে দিয়ে বিদায় নেন। এ সময় এই প্রতিবেদক পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও তাঁরা ছিলেন বেপরোয়া। এ সময় রেললাইন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন অনেকে। কাউকেই পরোয়া করেননি তাঁরা। পরে মাদক গ্রহণকারী যুবক জানান, তিনি বাসের হেলপার। বছর দুয়েক আগে থেকে ইয়াবা খাওয়া শুরু করেছেন। এখন আর একটায় কাজ না হওয়ায় দিনে দুইটা করে খান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইয়াবা এখন ছাত্ররাও বিক্রি করে। যার কাছ থেকে ইয়াবা নিলাম সে কলেজে পড়ে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কয়েক দিন পর দেখবেন দোকানে দোকানে ইয়াবা বিক্রি হইতাছে।’

সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার অন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্রদের প্রতি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ স্নেহশীল। এই সুযোগে কিছু বখাটে শিক্ষার্থী প্রকাশ্যে রাজধানীর অলিগলিসহ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক সেবন করছে। আর ক্যাম্পাসেই মিলছে স্বল্পমূল্যে মাদক। পড়াশোনার সঙ্গে বিচ্ছেদও ঘটছে তাদের। নতুন নতুন শিক্ষার্থীও মাদকে জড়াচ্ছে। স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীরাও কৌশলে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে কোকেন, গাঁজা, মদ, মারিজুয়ানা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, হিরোইন, প্যাথিডিন, সিসা, এলএসডির মতো মাদকের বিস্তার ঘটাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রীদের মাঝেও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে মাদকের বিস্তার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুলিশি নজরদারি না থাকায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় ভাইরাসের মতো মাদক ছড়িয়ে পড়ছে বলে কয়েকজন শিক্ষকের অভিযোগ। বড় ক্যাম্পাসগুলোতে বহিরাগতরা সন্ধ্যা হলেই মাদকের আসর বসায়। রাজধানীর একটি কলেজের এক শিক্ষিকা বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা আগের মতো সম্মান দেখায় না। আমাদের সামনেই সিগারেট, গাঁজা টানতে শুরু করে দেয়। কিছু বলাও যায় না। কিছু বললে অপমানিত হতে হয়।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীসহ সারা দেশের শহরগুলোর অলি-গলি, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়েছে নানা ধরনের মাদক। শিক্ষার্থীরা এক সময় রাখঢাক করে খেলেও এখন অনেকটা প্রকাশ্যে। দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এ পর্যায়ে নিয়ে গেছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।

নিয়ন্ত্রণে সংস্কার কমিশন গঠনের দাবি : মাদক ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী জানান, দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ যুবক-যুবতী। যাঁদের বেশির ভাগ মাদকে আসক্ত। এই যুবকদের বাঁচাতে না পারলে  দেশ ভয়াবহ এক সংকটের মুখে পড়বে।

তিনি বলেন, ‘দেশে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। আমি মাদকের মতো ভয়াবহ একটি বিষয়কে দূর করতে মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্কার কমিশন গঠনের দাবি জানাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘দেশে এখন ই-সিগারেট ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই সিগারেট থেকেও মাদকের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে শিক্ষার্থীসহ যুবসমাজ। আমরা ই-সিগারেট বন্ধের জন্য স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কাছে গত মাসে প্রস্তাব পাঠিয়েছি।’

কোটি ছাড়িয়েছে  মাদকসেবীর সংখ্যা : দেশে চার-পাঁচ বছর আগেও ৫০ থেকে ৬০ লাখ মাদকসেবী ছিল। কিন্তু কিছুদিন ধরে ব্যাপক হারে বেড়েছে এই সংখ্যা। মানসের গবেষণা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে এক কোটির বেশি মাদকসেবী। যার বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী। গত চার বছরে বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এ জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর শিথিলতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নজর আগের মতো নেই। ফলে মাদকসেবী ও কারবারিরা ভয় পাচ্ছে না। প্রায় প্রকাশ্যে চলছে বেচাকেনা। ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, ২০২০ সালে করোনার সময় থেকে মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ওই সময় থেকে অনলাইনে এসব বিক্রি বেড়ে যায়, যা দিন দিন প্রসারিত হয়েছে। ফলে এখন বিভিন্ন উৎস থেকে মাদক সংগ্রহ করতে পারছে। ফলে বিষয়টি আতঙ্কের হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যা বলছে : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, সারা দেশে মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রাজধানীর রেললাইনের আশপাশের বস্তি ও অন্যান্য মাদক স্পটে বিশ্বস্ত সোর্স নিয়োগের মাধ্যমে সংবাদ সংগ্রহেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের ছনপাড়া এলাকায় অবৈধ মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে অভিযানের নামে অহেতুক হয়রানি না করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি যৌথ বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযান প্রশংসিত হয়েছে।

মাদকের ভয়াবহ চিত্র : মাদকে আসক্ত সন্তানের অত্যাচার সইতে না পেরে ২০২৩ সালের ৬ মে গাজীপুরের জয়দেবপুরে ইয়াবা আসক্ত ছেলে আশরাফুলকে খুন করতে বাধ্য হন তার বাবা উমর ফারুক সবুজ। নেশার টাকার জন্য প্রায়ই বাসায় এসে ভাঙচুর করত আশরাফুল। মারধর করত মা-বাবাকে। ঘুষি মেরে ষাটোর্ধ্ব বাবার দুটি দাঁতও ভেঙে দেয় সে। তার মা ছেলের ভয়ে পালিয়ে থাকতে বাধ্য হতেন। এ অবস্থায় ছেলেকে হত্যা করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন সেই বাবা।

২০২২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মাদকাসক্ত সন্তান শাহ পরানকে (৩৩) পুলিশের হাতে তুলে দেন জামালপুরের সরিষাবাড়ী পৌরসভার চর বাঙালিপাড়া এলাকার দুলাল তরফদার। ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশি সহায়তায় ছেলে শাহ পরানকে ধরিয়ে দেন তিনি। ২০২১ সালের ৮ আগস্ট সন্তানের মাদক সেবনে অতিষ্ঠ হয়ে গাঁজা, হেরোইনসহ সনেট (২০) নামের এক তরুণকে পুলিশে সোপর্দ করেছে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের এক পরিবার। ২০২১ সালে ৯ অক্টোবর ফরিদপুরের ভাঙ্গার পাতরাইল দিঘিরপাড় গ্রামে মাদকাসক্ত ছেলে শফিকুল ইসলাম মৃধাকে (৪১) পুলিশের হাতে তুলে দেন তাঁর মা। ২০২৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের মুক্তগাছায় ইব্রাহিম নামের এক যুবককে পুলিশের কাছে তুলে দেন তাঁর মা-বাবা। ২০২৩ সালের ২৯ নভেম্বর কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে মোস্তাফিজার রহমান (২৯) নামের মাদকাসক্ত এক যুবককে পুলিশের হাতে তুলে দেন তাঁর বাবা-মা।

জামালপুরের চিত্র জানতে চাইলে জামালপুরের পুলিশ সুপার সৈয়দ রফিকুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘জামালপুরে আগে কী ছিল জানি না। বর্তমানে মাদক নিয়ন্ত্রণে আমরা সোচ্চার। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। মাদক নির্মূলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সবাই মিলে দায়িত্ব নিলে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button