বাংলাদেশের স্টার্টআপ জোয়ারে কি ভাটা পড়েছে?
সফল স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে তোলায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। গ্লোবাল স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম ইনডেক্স ২০২৪-এ ১০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৩তম, যেখানে ভারত ১৯তম, পাকিস্তান ৭১তম, আর শ্রীলঙ্কা ৭৬তম অবস্থানে রয়েছে।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশি স্টার্টআপগুলোর জন্য বিনিয়োগের গতিপ্রকৃতি রোলার কোস্টার যাত্রার মতো ছিল—উত্থান-পতনে ভরা। ব্যবসায় উত্থান-পতন স্বাভাবিক, তবে লাইটকাসল পার্টনার্সের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে স্টার্টআপ বিনিয়োগের ধারা বেশ অস্থিতিশীল, যা নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
২০১৮ সালকে যদি দেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের ‘উত্থানের’ সূচনা ধরা হয়, তাহলে সে বছর দেশীয় স্টার্টআপগুলো পেয়েছিল ১১৯ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। এরপরই কঠিন বাস্তবতা—২০২০ সালে বিনিয়োগ নেমে আসে ৫১ মিলিয়নে। তবে কোভিড-পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালে বিনিয়োগ হঠাৎ আকাশ ছুঁয়েছিল। সে বছর বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪৩৫ মিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগে এমন বিশাল লাফের বড় কারণ ছিল জাপানের সফটব্যাংক। কোম্পানিটি একাই বিকাশে বিনিয়োগ করেছিল ২৫০ মিলিয়ন ডলার।
কিন্তু এই জোয়ার স্থায়ী হয়নি। ২০২২ সালে বিনিয়োগ কমে দাঁড়ায় ১২৫ মিলিয়নে ডলারে, ২০২৩-এ আরও কমে ৭১ মিলিয়নে, আর ২০২৪ সালে এসে মাত্র ৩৫ মিলিয়ন ডলারে নেমে ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে পৌঁছেছে। করোনা মহামারি বা ইউক্রেন যুদ্ধের মতো ক্লিশে অজুহাত দিয়ে আর এই ধস ব্যাখ্যা করা যায় না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সুদহার বৃদ্ধি; বিনিয়োগকারীদের মনোযোগ ই-কমার্স, ফিনটেক ও লজিস্টিকস থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) দিকে সরে যাওয়া; স্টার্টআপগুলোর দুর্বল নেতৃত্ব এবং সফল এক্সিট দুর্লভ হয়ে যাওয়া অন্যতম।
সফল স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে তোলায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। গ্লোবাল স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম ইনডেক্স ২০২৪-এ ১০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৩তম, যেখানে ভারত ১৯তম, পাকিস্তান ৭১তম, আর শ্রীলঙ্কা ৭৬তম অবস্থানে রয়েছে।
ভারতের সাফল্যের পেছনে রয়েছে বিশাল ভোক্তা বাজার, কম খরচের ইন্টারনেট এবং শক্তিশালী ডিজিটাল অবকাঠামো। তুলনামূলক ছোট অর্থনীতির দেশ হয়েও পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ টানতে পেরেছে, কারণ তারা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে কিছুটা হলেও সফল হয়েছে।
এই আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সংগ্রাম আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে স্টার্টআপের সংখ্যা এখন ১ হাজার ২০০ ছাড়ালেও বেশিরভাগ স্টার্টআপই সীমিত বাজার এবং খণ্ডিত গ্রাহকদের জন্য কাজ করে। তার ওপর চড়া ইন্টারনেট খরচ এই সমস্যা আরও প্রকট করে তুলেছে।
ভারতে সাশ্রয়ী ইন্টারনেট সুবিধা যেখানে ই-কমার্স ও এডটেক শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলো গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতেই হিমশিম খাচ্ছে। পাঠাও-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ফাহিম আহমেদের মতে, ‘চড়া ইন্টারনেট খরচের কারণে মোট সম্ভাব্য গ্রাহকদের সংখ্যা সীমিত’; আর এটাই বাংলাদেশের স্টার্টআপ ও প্রযুক্তি ইকোসিস্টেম দুর্বল থেকে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
তবে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগ আকর্ষণ করা স্টার্টআপগুলো মূলত ই-কমার্স, ই-লার্নিং, ফিনটেক ও লজিস্টিকস খাতের ছিল।
বিডিজবস ডটকম-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস-এর (বেসিস) সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘একটা বিষয় মাথায় রাখা জরুরি—এই অঞ্চলে এ ধরনের স্টার্টআপগুলো তেমন লাভজনক হয়নি। যেমন ধরুন, ভারতের বাইজুস এখন দেউলিয়া হওয়ার মুখে। এসব ব্যবসা নিয়ে যে বিপুল আলোড়ন তোলা হয়েছিল, বাস্তবে তার সঙ্গে প্রত্যাশার মিল খুব কমই দেখা গেছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা এসব খাতে বিনিয়োগ কমিয়ে দিচ্ছেন।’
‘সেইসঙ্গে এআই নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিশাল আগ্রহ তৈরি হয়েছে। আর এর ফলেই বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ চলে যাচ্ছে সেদিকে। আমার বিশ্বাস, আগে যে তহবিল আমাদের মতো খাতে আসত, বিনিয়োগকারীরা তা এখন এআইতে ঢালছে। তবে এসব বিনিয়োগ মূলত উন্নত দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ; কিছুটা ভারতেও গেছে। দুর্ভাগ্যবশত, এআইতে বিনিয়োগে এই উত্থানের সুবিধা বাংলাদেশ পায়নি,’ বলেন তিনি।
নীতিগত ও নিয়ন্ত্রক চ্যালেঞ্জও বিনিয়োগের পথে বাধা। বাংলাদেশের নন-কনভার্টিবল মূলধনী হিসাব বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য মুনাফা দেশে নিয়ে যাওয়া কঠিন করে তোলে। এর ফলে বড় বিনিয়োগকারীরা আসতে উৎসাহী হয় না।
ফলে এসব এসব বিধিনিষেধ এড়াতে বাধ্য হয়েই অনেক স্টার্টআপ বিদেশে নিবন্ধিত হয়। এতে স্থানীয় বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে আরও জটিল হয়ে ওঠে। এছাড়া করনীতিতেও বিনিয়োগকারীদের জন্য তেমন কোনো প্রণোদনা নেই, যা তাদের আস্থা আরও কমিয়ে দেয়।
সফল এক্সিটের ঘটনা না থাকাও আরেকটি বড় ইস্যু। উন্নত স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে আইপিও বা কোম্পানি অধিগ্রহণের মতো ঘটনাগুলো দেখায় যে এসব ব্যবসার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। এতে আরও বিনিয়োগ আসে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও বড় কোনো ‘লিকুইডিটি ইভেন্ট’ ঘটেনি।
বিকাশ, পাঠাও ও শপআপ কিছুটা নজর কাড়লেও পুরো ইকোসিস্টেম এখনও যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারেনি।
ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘সফল এক্সিট ছাড়া বিনিয়োগকারীদের আস্থা গড়ে তোলা কঠিন। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীদের সফল এক্সিটের নজির খুবই বিরল।’
এর মধ্যেই ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে। আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন, এরপর গণ-অভ্যুত্থানে দীর্ঘদিনের একনায়কতন্ত্রের পতনে—যেখানে পুলিশের গুলি আর সরকারি দলের ক্যাডারদের হাতে শত শত মানুষ নিহত হয়েছে—গোটা দেশই পুরোপুরি পাল্টে গেছে।
এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে স্টার্টআপগুলোর জন্য বিনিয়োগ পাওয়া এবং ব্যবসা বড় করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে জুলাই-আগস্টের সেই কয়েকদিন, যখন ক্ষমতাচ্যুত শাসকগোষ্ঠী দেশব্যাপী ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট চালায়, তখন অনেক স্টার্টআপই বড় ধাক্কা খায়।
ছোট বাজার, চড়া ইন্টারনেট খরচ, নিম্নমানের স্থানীয় পণ্য, দুর্বল প্রতিষ্ঠাতা ও নেতৃত্বের সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা মিলে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম আরও দুর্বল হয়েছে। ‘তাই বর্তমানের মতো এমন অস্থিতিশীল ম্যাক্রো-ইকোনমিক বা রাজনৈতিক পরিবেশে বিনিয়োগ সংকুচিত হবে, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই,’ বলেন পাঠাওয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফাহিম আহমেদ।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম এখনও শৈশব কাটাচ্ছে। এখানে কোনো সফল পূর্ণ এক্সিট ঘটেনি, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে পারত। এখনও পর্যন্ত কোনো স্টার্টআপ পুরোপুরি বিক্রি হয়ে বিনিয়োগকারীদের সম্পূর্ণ ও লাভজনক এক্সিট দিতে পারেনি।
‘সত্যি বলতে কী, পাঠাও বাংলাদেশের হাতেগোনা কয়েকটি স্টার্টআপের একটি, যেখানে এক বা একাধিক শেয়ারহোল্ডার আংশিক হলেও লাভজনক এক্সিট নিতে পেরেছেন।’