ইসরায়েলে ধ্বংসস্তূপ

পাল্টাপাল্টি তীব্র হামলা, দুই পক্ষে হতাহত সহস্রাধিক, শান্তি সম্ভাবনার কথা ট্রাম্পের
ইরানের মিসাইল হামলায় তছনছ হয়ে গেছে ইসরায়েলের বিভিন্ন অঞ্চল। গত শনিবার মধ্যরাত থেকে গতকাল ভোর পর্যন্ত মিসাইলগুলো বৃষ্টির মতো আঘাত হানে ইসরায়েলের হাইফা, তেল আবিব, বাত ইয়াম, জেরুজালেমসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে। এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাইপার তেল শোধনাগার, রেহোভতে অবস্থিত উইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু প্রতিষ্ঠান। অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। অন্যদিকে ইসরায়েল গতকাল সকাল থেকে কয়েক দফায় ইরানের ওপর বিমান হামলা চালায়। একটি হামলায় ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হামলার সময় ইসরায়েলের ১০টি যুদ্ধবিমানকে ভূপাতিত করা হয়েছে বলে তেহরান জানিয়েছে। এদিকে ‘যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা চালানো হলে’ ইরানকে লন্ডভন্ড করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একই সঙ্গে শান্তি ও সম্ভাবনার কথাও বলেছেন তিনি। উত্তেজনা কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্য মধ্যপ্রাচ্যে আরও যুদ্ধবিমান পাঠানো শুরু করেছে। সূত্র : রয়টার্স, আলজাজিরা, বিবিসি, এএফপি।
খবরে বলা হয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ধসে পড়ছে ইসরায়েলের আত্মবিশ্বাস। শনিবার মধ্যরাতের পর থেকে টানা মিসাইল হামলায় কেঁপে উঠেছে হাইফা, তেল আবিব, বাত ইয়াম, জেরুজালেমসহ ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো। এসব হামলায় অন্তত ১৪ জন নিহত এবং সহস্রাধিক আহত হয়েছে বলে স্বীকার করেছে স্থানীয় প্রশাসন। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, একের পর এক বিস্ফোরণে ইসরায়েলের বাত ইয়াম শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ইসরায়েলি হামলায় ইরানের বিচার মন্ত্রণালয় ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে গতকালও কয়েক ডজন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। হোম ফ্রন্ট কমান্ডের বরাত দিয়ে ইসরায়েলি সূত্র থেকে জানানো হয়, তেল আবিবের দক্ষিণে অবস্থিত বাত ইয়ামে গতকাল দিনভর উদ্ধারকাজ চলেছে। আরেক খবরে বলা হয়, ইরানের সর্বশেষ এই হামলায় ব্যবহার করা হয়েছে দ্রুতগতির মিসাইল ও ড্রোন। মিসাইল হামলায় মধ্য ইসরায়েলের রেহোবতের ‘ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’-এর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইরানি হামলায় পাবলিক গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়টির ল্যাবরেটরিতে আগুন ধরে যায়। এ ছাড়া তছনছ হয়ে গেছে ইসরায়েলের কয়েকটি শহর। ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় শহর হাইফার তেল শোধনাগার পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ‘বাজান’ জানিয়েছে, ইরানের হামলায় ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় শহর হাইফার তেল শোধনাগার বিধ্বস্ত হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, ইরানের রাতভর হামলায় তেল শোধনাগার কমপ্লেক্সের ভিতরে পাইপলাইন ও সঞ্চালন লাইনের নির্দিষ্ট জায়গাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে তেল শোধনাগারটির কিছু ইউনিট ও স্থাপনা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। ক্ষতির প্রভাব মূল্যায়ন করা হচ্ছে। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ইরানি বাহিনী রাতভর ইসরায়েলের দিকে প্রায় ৮০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। এগুলোর মধ্যে ৪০টি পড়েছে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে। এই অঞ্চলেই হাইফা অবস্থিত।
ইরানি গণমাধ্যম বলেছে, এই অভিযানে ব্যবহৃত হয়েছে ‘ইমাদ’ ‘গাদর’ ও ‘খাইবার শেকান’ নামের অত্যাধুনিক ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। ইরান বলেছে, এ হামলা ছিল শুক্র ও শনিবার সকালে তেহরানসহ বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলি হামলায় নিহত সেনা কমান্ডার ও সাধারণ মানুষের মৃত্যুর জবাব। আইআরজিসি দাবি করেছে, দখলকৃত অঞ্চলে এটিই তাদের সবচেয়ে বড় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। এতে ইসরায়েলের হাইপার তেল শোধনাগারসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ও স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে।
এদিকে গতকাল সকালে ইরানের খাতাম আল-আম্বিয়ার কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরের কমান্ডার মেজর জেনারেল আলী শাদমানি এক ঘোষণায় বলেছেন, ইসরায়েলে আরও ধ্বংসাত্মক মাত্রার হামলা চালানো হবে। তিনি বলেন, ইসরায়েল অনুতপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ধ্বংসাত্মক মাত্রার আক্রমণ অব্যাহত থাকবে এবং আক্রমণের মাত্রা ক্রমে বাড়তে থাকবে।
অন্যদিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তারা গতকাল সকালে ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছে। পাশাপাশি ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বলছে, ইসরায়েলের বিমান হামলায় তেহরানের এক আবাসিক ভবন কমপ্লেক্সে ৬০ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ২০ শিশুও রয়েছে। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, ইসরায়েলি জঙ্গি ও বোমারু বিমান সকালের হামলায় অংশ নেয়। এ ব্যাপারে ইরানি কর্তৃপক্ষ বলেছে, এ সময় ইরান মাত্র এক ঘণ্টায় ইসরায়েলের ১০টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। যদিও ইসরায়েল এই দাবি অস্বীকার করেছে। সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, ইরানের রাজধানী তেহরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আবারও একাধিক বিস্ফোরণের তীব্র শব্দ শোনা গেছে। স্থানীয় সময় রবিবার দুপুরে এ বিস্ফোরণ ঘটেছে। সেখানে সক্রিয় করা হয়েছে বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।
মোসাদের দুই গুপ্তচর গ্রেপ্তার : ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে ইরান। এই দুই ব্যক্তি আলবোর্জ প্রদেশে বিস্ফোরক ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বানানোর সময় ধরা পড়েছেন।
ইসরায়েলে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা : ইরানের সঙ্গে চলমান হামলা-পাল্টাহামলার মাঝে ইসরায়েলে বড় ধরনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তেহরানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র ইয়েমেন। গতকাল ভোরের দিকে ইসরায়েলের বাণিজ্যিক রাজধানী তেল আবিবে এই হামলা চালানো হয়েছে। ইয়েমেনের সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেছেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সঙ্গে সমন্বয় করে ইসরায়েলের তেল আবিবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। ইয়েমেন থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারি বলেছেন, তেল আবিবের কেন্দ্রে দখলদারদের বিরুদ্ধে নতুন সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে ইয়েমেনি বাহিনী। তিনি বলেন, রবিবার ভোরে যে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে, তা সফলভাবে নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। তিনি আরও বলেন, ইয়েমেনের বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র ইউনিট থেকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইসরায়েলের দখলকৃত ইয়াফা অঞ্চলে ‘ফিলিস্তিন-২’ নামের একাধিক হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হবে।
যা বললেন ট্রাম্প : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওয়াশিংটন ডিসিতে শনিবার এক সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে ইরানকে হুমকি দিয়ে বলেন, ইরান যদি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা চালায় তাহলে দেশটিকে লন্ডভন্ড করে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের শত্রুরা সাবধান থাকুক।’ ট্রাম্প বলেন, ‘ইরান যদি আমাদের ওপর যে কোনো ধরনের, যে কোনো উপায়ে হামলা করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী এমন তৎপরতা চালাবে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘তবে আমরা সহজেই ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চুক্তি করতে পারি এবং এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারি।’
যুক্তরাজ্যের যুদ্ধবিমান : ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ঘোষণা করেছেন, যুক্তরাজ্য মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সামরিক সরঞ্জাম ও যুদ্ধবিমান পাঠানো শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী জানান, ওই অঞ্চলজুড়ে জরুরি সহায়তা দেওয়ার জন্যই যুদ্ধবিমান পাঠানো হচ্ছে।
ইরানের সঙ্গে চলমান সংঘাতের মধ্যে নাগরিকদের ইসরায়েলে ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়ে নির্দেশিকা হালনাগাদ করেছে যুক্তরাজ্য। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল এ পরামর্শ দিয়েছে। কিয়ার স্টারমার কানাডায় ধনী দেশগুলোর জোট জি-৭-এর সম্মেলনে অংশ নিতে যাওয়ার পথে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
ইরান ও ইসরায়েলের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কিয়ার স্টারমার শনিবার সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে তাঁর সরকারি দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।